সারদা সুতোয় জড়িয়ে গিয়েছেন দলের মাথারা। কখনও সিবিআই কখনও বা এসফআইও কিংবা ইডি ত্রিফলা তদন্তে থেকে থেকেই তলব পড়ছে শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের। টালমাটাল এই অবস্থায়, দলের মেজ-সেজ নেতাদের কলহ-বিবাদে নজরদারির সময় কোথায় তাঁদের?
‘অভিভাবকহীন’ তৃণমূলে তাই নিরন্তর বেড়ে চলেছে কোন্দল। দলে, কে ‘খাঁটি’ কে ‘নকলের’ লড়াইয়ে বাড়ছে পারাস্পরিক সন্দেহ। জেলার আনাচ-কানাচ থেকে অহরহ আসা হাতাহাতির নালিশে তৃণমূল ভবনে কান পাতা দায়। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মাথারা চোখ বুজে ফেলেছেন। হাত-পায়ে কী হচ্ছে সে দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়!”
পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের দু’টি ঘটনায় দলের ছন্নছাড়া চেহারা, ফের স্পষ্ট হল শুক্রবার। ঘটনাস্থল নন্দীগ্রাম ও খেজুরি। শুধু পূর্ব মেদিনীপুর নয়, দলের উত্থান-ভূমি হিসেবেও এলাকা দু’টির পরিচয় রয়েছে। দলের সেই দুই শক্ত ঘাঁটিতেই, সামান্য দু’টি ঘটনাকে ঘিরে দলীয় কোন্দল সামনে এসে পড়ল।
আজ, শনিবার, নন্দীগ্রামে জমি রক্ষা আন্দোলনের অষ্টম বর্ষপূর্তির ঠিক আগে সামসাবাদে দলের মহিলা উপ-প্রধান সবিতা মণ্ডলের স্বামী শুকদেবকে মারধরের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের অন্য এক পঞ্চায়েত সদস্য এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। গ্রামবাসীরা জানান, সকালে পঞ্চায়েত প্রধান অতনু জানার সঙ্গে মোটরবাইকে পঞ্চায়েত অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন শুকদেব। পথে তাঁদের বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়। অভিযোগের তির দলীয় পঞ্চায়েত সদস্য রহিমুল ইসলাম এবং তার সঙ্গীদের দিকে। মারধরের পর শুকদেবকে আটকে রাখা হয় একটি বাড়িতে। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে।
খেজুরি-১ ব্লকের কলাগেছিয়াতেও হামলার অভিযোগ উঠেছে দলের পঞ্চায়েত সদস্য পরমেশ্বর মণ্ডলের বিরুদ্ধে। কলাগেছিয়া পঞ্চায়েত প্রধান বিপ্লববহ্নি দাসের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছেন পরমেশ্বরের অনুগামীরা। ৬ জানুয়ারি সে ব্যাপারে ভোট। এ দিন বিপ্লববহ্নির ঘনিষ্ঠ জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম দাসের গাড়িতে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। কামারদা অঞ্চলে তৃণমূল বুথ-সভাপতি অমিতাভ দাসকেও মারধর করে আটক রাখা হয় একটি বাড়িতে। পরমেশ্বর গোষ্ঠীর ‘দাদাগিরি’র প্রতিবাদে পথ অবরোধ করেন দলের অন্য গোষ্ঠীর সমর্থকেরা। ওই গ্রামে সন্ধ্যায় যায় পুলিশ। উদ্ধার করা হয় অমিতাভকে। এর পরেই দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ বাধে। জখম হয় চার জন। আহতদের ভর্তি করানো হয়েছে তমলুক হাসপাতালে। মার-পাল্টা মারের এই রাজনীতিতে দলেরই বেশ কয়েক জন কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
দিন কয়েক আগেই কলহ-দীর্ণ পূর্ব মেদিনীপুরে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়ে ছিলেন, “মনে রাখবেন আমরা সবাই এক। আমি কে, ও কে দেখার দরকার নেই। কথাটা আমি নয়, আমরা।” কিন্তু সে কথা শুনছে কে? পালাবদলের সানে তিন বছরের মধ্যেই দলনেত্রীর নির্দেশও যে মান্যতা পাচ্ছে না এ দিনের ঘটনা, চোখে আঙুল দিয়ে তা ফের দেখিয়ে দিচ্ছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএম সম্পাদক প্রশান্ত প্রধান যা দেখে বলছেন, “সারদার ভাগ-বাঁটোয়ারা আর পদের লড়াইয়ে জেরবার তৃণমূল। মাথাগুলো একে একে জেলে ঢুকছে। নিচুতলার কর্মীরা তাই দিশাহারা হয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে। সে দিকে নজর দেবে কে?” আর বিজেপি-র জেলাসভাপতি তপন করের কটাক্ষ, “খেয়োখেয়ি করে দলটা উঠে যেতে বসেছে। শাসন করার কেউ নেই।” কোন্দল-সঙ্কট মেটাতে তাই নতুন করে ‘শাসনের’ তোড়জোড় করছে দল। দলের এক প্রথম সারির নেতা বলেন, “আজ, শনিবার কালীঘাটে নিজের বাড়িতেই দলের শীর্ষনেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন দলনেত্রী। জেলায় জেলায় কোন্দল থামাতে অন্য কী শাসনের বার্তা দেন তিনি, সেখানেই বোঝা যাবে।”