শ্যামল সেন কমিশন নিয়ে কথা দিয়েও কথা রাখল না রাজ্য সরকার।
সারদা কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানোর লক্ষ্যে বিচারপতি শ্যামলকুমার সেনের নেতৃত্বে মমতা সরকার যে কমিশন গড়েছিল, দু’মাস আগে তার ঝাঁপ পড়ে গিয়েছে। রাজ্যের জারি করা সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকায় তখন বলা হয়েছিল, আমানতকারীদের টাকা ফেরত-সহ কমিশনের অন্যান্য সুপারিশ সম্পর্কে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের কাছে তা জানতে চাওয়া হবে। অথচ দু’মাসের মধ্যেও আদালতের দরজায় কড়া নাড়ার কোনও উদ্যোগ সরকারের তরফে চোখে পড়ছে না!
এবং কবে সেই উদ্যোগ শুরু হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, তা-ও কেউ বলতে পারছেন না। স্বয়ং বিচারপতি শ্যামল সেনও এ সম্পর্কে অন্ধকারে। “কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল, সুুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের নির্দেশ নেওয়া হবে। নেওয়া হয়েছে কি না, খবর পাইনি।” বলেছেন তিনি। সারদায় ক্ষতিগ্রস্তেরা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। আমানতকারী ও এজেন্ট সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক সুবীর দে’র ঘোষণা, রাজ্য সরকার কেন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না, তা জানতে আগামী জানুয়ারিতে তাঁরা নবান্ন অভিযানের পরিকল্পনা করছেন।
সুর চড়িয়েছেন বিরোধীরাও। সুপ্রিম কোর্টে যাঁর মামলার জেরে সারদা-তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, “সবই ষড়যন্ত্র। আমানতকারীদের বোকা বানাতে সরকার ওই নির্দেশিকা দিয়েছিল। মানুষ এখন সব ধরে ফেলেছে।” কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের দাবি, “চিঠিটিতে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের নির্দেশ নেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী তা নেওয়ার ক্ষমতাই সরকারের নেই! স্রেফ ধাপ্পাবাজি।” আর বিজেপি রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারির পর্যবেক্ষণ, “ওটা তো কমিশন বন্ধ করার ছুতো ছিল! পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকিয়ে তৃণমূলের কিছু লোককে টাকা ফেরত দিতে সরকার সারদা কমিশন বানিয়েছিল। এখন সিবিআই এসে যাওয়ায় টাকার ঝাঁপিও বন্ধ!”
বস্তুত সুবীরবাবুরাও পুরো ঘটনার পিছনে সিবিআই-আতঙ্কের ছায়া দেখছেন। ওঁদের ব্যাখ্যা, “কমিশন চালু থাকলে একটা সময় সিবিআই সেখানেও পৌঁছে যেত! কারা টাকা পেয়েছে, রাজ্য সরকারের স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের বানানো ক্ষতিপূরণ-প্রাপকদের তালিকায় গরমিল রয়েছে কি না সব যাচাই করতো। আমাদের ধারণা, তাই তড়িঘড়ি কমিশন তুলে দেওয়া হল।”
অর্থ দফতরের তথ্য বলছে, ২০১৩-র ২৩ এপ্রিল কমিশন চালু হওয়া ইস্তক বিভিন্ন লগ্নিসংস্থায় টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সাড়ে ১৭ লক্ষ জন ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেন। এঁদের মধ্যে সাড়ে ১২ লক্ষ আমানতকারী সারদায় লগ্নি করে প্রতারিত হয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয়, শুধু ওঁদেরই ক্ষতি পূরণ করা হবে। সেই মতো পাঁচ দফায় মোট প্রায় ৫ লক্ষ সারদা-গ্রাহকের নামে চেক তৈরি হয় সব মিলিয়ে অন্তত আড়াইশো কোটি টাকার। কিন্তু শ্যামল সেন কমিশনে কাজ করা আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, প্রাপকদের নাম-ঠিকানার তালিকা তৈরিতে ভুলভ্রান্তি ও নির্বাচনী বিধির জেরে এঁদের অন্তত এক লক্ষ জন টাকা হাতে পাননি, যাঁদের প্রাপ্যের মিলিত অঙ্ক ১০৩ কোটি টাকা।
ওই অফিসারেরা জানান, তারিখ পেরিয়ে যাওয়ায় ওই চেকগুলো কমিশনে ফেরত এসেছে। এই মুহূর্তে টাকাটা কমিশনের অ্যাকাউন্টেই জমা রয়েছে। সঙ্গে আগে গচ্ছিত ৩৬ কোটি মিলিয়ে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা কমিশনের ভাঁড়ারে রয়েছে বলে প্রশাসন-সূত্রের খবর।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বারবার বিভিন্ন জায়গায় দাবি করছেন, নিজের গড়া কমিশন মারফত তাঁর সরকার সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ লক্ষ মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে বাস্তবের এ হেন ফারাক দেখে আমানতকারীদের অনেকে বিভ্রান্ত, ক্ষুব্ধও। সুবীরবাবুর অভিযোগ, “সারদায় তিন হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রেখেছিলেন, এমন অনেকেই তো এখনও কিছু পাননি। অথচ সরকার বলছে, কুড়ি হাজার পর্যন্ত সব আমানতকারী টাকা পেয়ে গিয়েছেন!” শ্যামবাজারের শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় সারদায় দশ হাজার টাকা রেখে ঠকেছেন। তিনি জেনেছেন, তাঁর নামে চেকও লেখা হয়ে যায়, কিন্তু ভোট বিধির গেরোয় তা আর হাতে আসেনি। “রাজ্য ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েও সব গুটিয়ে নিল! এখন আর চাড় নেই! এ ভাবে তো ফের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে!” আক্ষেপ শুভাশিসবাবুর।
তা হলে রাজ্য সরকার এখন কী করার কথা ভাবছে?
অর্থ দফতরের কেউ এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। প্রতারিত গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় রাজ্য সরকারের যে দফতর বহাল, সেই ক্রেতা-সুরক্ষা এ ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নিতে পারে না?
ক্রেতা-সুরক্ষামন্ত্রী সাধন পাণ্ডের বক্তব্যে তেমন ইঙ্গিত নেই। বরং তিনিও কার্যত রাজ্য সরকারের ঘাড় থেকে দায়িত্ব নামানোর পক্ষপাতী। সাধনবাবু বৃহস্পতিবার বলেন, “সরকার তো কিছু কিছু করে টাকা দিচ্ছিল। পরে ইডি জানিয়ে দিল, কমিশন সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে না, যা করার ইডি-ই করবে। এখন তা হলে ওরাই টাকা ফেরতের দায়িত্ব নিক।” যদিও শ্যামল সেন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এক কর্তার মতে, সারদার প্রতারিতদের আরও অনেককে টাকা ফেরাতে সরকারের অন্তত আর্থিক সমস্যা থাকার কথা নয়। “একশো চল্লিশ কোটি তো কমিশনের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টেই আছে! তা হলে অসুবিধে কোথায়?” প্রশ্ন ওই কর্তার।
ওঁর প্রশ্নের জবাব দেবে কে? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।