মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রেজ্জাক মোল্লা। শুক্রবার বিধানসভায়। ছবি: সুমন বল্লভ।
নবান্নে গিয়ে আত্মসমর্পণের তকমা মুছতে বিধানসভার ভিতরে-বাইরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াল বামফ্রন্ট। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিতণ্ডা বাধল বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের। শাসক ও বিরোধী শিবিরের বিধায়কদের তরজায় শুক্রবার প্রায় হারিয়েই গেল নবান্নে তৈরি হওয়া দু’পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্যের আবহ! আর বিধানসভার বাইরে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ঘোষণা করে দিলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে সন্ত্রাস-কবলিত ও ঘরছাড়া মানুষদের নিয়ে কলকাতায় তাঁরা ২৫ জুন থেকে তিন দিনের অবস্থান-বিক্ষোভে বসবেন।
সন্ত্রাস বন্ধ ও ঘরছাড়াদের ফেরানোর দাবি নিয়েই সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বিমানবাবুরা। তাতে বাম শিবিরের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল তা হলে কি লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে শাসক দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এলেন বিমানবাবুরা? সেই বিভ্রান্তি কাটাতে এ দিন গোড়া থেকেই সক্রিয় ছিলেন সূর্যবাবুরা। বিধানসভায় সরকারি পক্ষের সঙ্গে সরাসরিই সংঘাতে গিয়েছেন তাঁরা। জবাবে পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলনেতার চিঠির ভাষা নিয়ে। আর এ সবেই কেটেছে ‘বন্ধুত্বে’র পরিবেশ। দিনের শেষে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিমানবাবু ও সূর্যবাবুর মধ্যে বিভাজনের কৌশল প্রয়োগ করতে চেয়ে মন্তব্য করেছেন, “সূর্যবাবুরা যে ব্যবহার করলেন, আগের দিন নবান্নে এসে বাম নেতারা কিন্তু তেমন করেননি!”
সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকেই নিশানা করে এ দিন বিধানসভা থেকে দু’বার ওয়াকআউট করেছেন বাম বিধায়কেরা। নিজের হাতে ৮টি দফতরের দায়িত্ব থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী কেন তিন বছরে এক বারও বিধায়কদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, এই নিয়ে প্রথমার্ধে অধিবেশন কক্ষে বিক্ষোভ এবং পরে ওয়াকআউট করেন বামেরা। দ্বিতীয়ার্ধে পুলিশ বাজেটের উপরে মুখ্যমন্ত্রীর জবাবের সময় ‘অসত্য তথ্য’ এবং তৃণমূল বিধায়কদের ‘অশোভন আচরণে’র প্রতিবাদ করে ফের সভাকক্ষ ছাড়েন তাঁরা। তার আগে অবশ্য সুভাষ নস্কর, উদয়ন গুহ এবং বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বাম শিবিরের তিন বক্তারই বক্তব্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেসের রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শাওনি সিংহ রায় বা তৃণমূলের শীলভদ্র দত্ত, পার্থ ভৌমিকদেরও। বাম জমানার শেষ চার বছর হামেশাই বিধানসভার বাইরে থাকত তৃণমূল। বামেদের কৌশল অবশ্য ভিন্ন। নিজেদের বক্তব্য নথিভুক্ত করেই সভা ছেড়েছেন তাঁরা। পরে সূর্যবাবু বলেছেন, “প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের বয়কট করতে চাইছেন। এই রকম চললে আমরাও ওঁকে বয়কট করব!”
আলিমুদ্দিনে এ দিনই বামফ্রন্টের বৈঠক করে আত্মসমর্পণের তত্ত্ব খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন বিমানবাবুরাও। ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, জরুরি অবস্থার বর্ষপূর্তির দিন ২৫ জুন থেকে তিন দিন শাসক দলের আক্রমণের প্রতিবাদেই অবস্থান হবে। বিমানবাবুর কথায়, “সরকারের কথা ও কাজে মিল নেই! মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সব অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কাজে কিছু দেখা যাচ্ছে না!” তবু মুখ্যমন্ত্রীর সূত্র মেনেই সন্ত্রাস-কবলিত আমডাঙায় বাম নেতাদের সফরের রিপোর্ট তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠাচ্ছেন বিমান।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিধানসভায় জানিয়েছেন, বামেদের অভিযোগ খোঁজ নিয়ে তিনি দেখেছেন, বেশির ভাগই ভিত্তিহীন! তাঁর তথ্য, ২০১৪ সালে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘর্ষে রাজ্যে ১২ জন মারা গিয়েছেন। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “রাজনৈতিক সংঘর্ষ কোথায়? আমি তো ঘটতেই দিই না। এত বড় জয়ের পরে আমাদের ছেলেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি গেয়ে বেড়িয়েছে!”
বাজেট-বিতর্কে বক্তা তালিকায় নাম না থাকলেও বামেদের
বিড়ম্বনায় ফেলতেই এ দিন বহিষ্কৃত সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে বলার জন্য বার্তা পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। বার্তায় সাড়া দিয়ে রেজ্জাকও বলতে উঠে বামেদের নবান্ন-বৈঠককে কটাক্ষ করে বলেন, “যার গরু ধান খেয়েছে, তার কাছেই গেলেন বিচার চাইতে! একেই বলে বুদ্ধির ঢেঁকি!” পরে রেজ্জাকের সঙ্গে দেখা হতে তাঁকে বিধায়ক-পদে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলের সমর্থনেই ফের ভোটে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন সূর্যবাবু! ফিরিয়ে দিয়েছেন কটাক্ষও, “গরুদের হাতেই যখন উনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, আমরা গিয়েছিলাম। এখন উনি যখন এ সব বলছেন, সেই গরুদের দিক থেকেই হাততালি আসছে!” শাসক দলকে পাল্টা অস্বস্তিতে ফেলতে অর্জুন সিংহ-প্রসঙ্গও এ দিন বিধানসভায় তুলে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। অর্জুন অবশ্য এ দিনও মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি।