যাঁদের আন্দোলনে রাশ টানতে রীতিমতো কড়াকড়ি শুরু করেছিল রাজ্য সরকার, সেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের পাশে থাকার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ারদের আন্দোলনে সহমর্মিতা দেখানো বিরোধীদেরও বিঁধতে ছাড়লেন না। তবে আচমকা দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, কেন সুর বদলাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী?
সোমবার মেদিনীপুর শহরের কলেজ মাঠে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সিভিক পুলিশদের (তাঁর সরকারই অবশ্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স থেকে পুলিশ শব্দটি ছেঁটে দিয়েছে) যাঁরা আছেন, মনে রাখবেন, আপনারা কাজটা শুরু করেছেন। ভাল ভাবে কাজ করুন। আপনাদের কেউ চাকরি থেকে ছাঁটাই করবে না।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাসবাণীতে অবশ্য সর্বত্র চিঁড়ে ভেজেনি। সিভিক ভলান্টিয়ার্স সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সঞ্জয় পড়্যা পশ্চিম মেদিনীপুরেরই ছেলে। কেশপুরে বাড়ি। তাঁর বক্তব্য, “সরকারি সভায় বক্তৃতা করে আশ্বাস দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের সংগঠনের সভায় মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য রাখুন। তা হলেই তো ওঁর বার্তা সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাছে পৌঁছে যাবে।” তিনি জানিয়েছেন, নিজেদের ভবিষ্যতের সুরক্ষার প্রশ্নে তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির পরেও তাঁরা আইনি লড়াই থেকে সরবেন না। থামাবেন না আন্দোলনও।
জঙ্গলমহলের জেলায় গিয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সিভিক ভলান্টিয়ারদের উদ্দেশে বলেন, “আমি চাই, আপনারা ভাল করে মাথা তুলে দাঁড়ান। ভবিষ্যৎ ভাল হোক। (চাকরিতে) মাথাটা গলিয়েছেন, এটাই বড় ব্যাপার। এটা আপনাদের চাকরি। চাকরি-চাকরিতেই থাকবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। মনে রাখবেন, আমাদের সরকার কারও চাকরি খায় না। চাকরি দেয়।”
রাজ্যের ভাঁড়ারে টাকা নিয়ে টানাটানি মিটলে আরও বেশি করে সিভিক ভলান্টিয়ারদের কথা ভাবা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মমতা। বলেন, “এখন টাকা নেই। সব টাকা দিল্লি কেটে নিচ্ছে। যখন টাকা হবে, তখন আমরা আরও ভাবব।”
নাম না করে এর পরেই বিরোধীদের এক হাত নেন তৃণমূল নেত্রী। বলেন, “কিছু লোক আছে যারা সুযোগ দেয় না, কাজও দেয় না। কেউ কাজ পেলে তাকে কী করে বিশৃঙ্খল করে কাজটা ছাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করে। আপনারা কারও কথা শুনবেন না। পুলিশে কাজ করতে গেলে শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে। ভাল ভাবে, সুন্দর ভাবে কাজটা করুন।” মুখ্যমন্ত্রী যখন এ কথা বলছেন, তখন মঞ্চে বসে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি প্রমুখ।
গত লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য জুড়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজার সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স নিয়োগ করেছিল রাজ্য সরকার। তখন অভিযোগ উঠেছিল, ‘জনমোহিনী রাজনীতি’ করতে রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, গত ১০ জুলাই কলকাতার রানি রাসমনি রোডে বিক্ষোভ সমাবেশের পরে ওই মাসেই ভলান্টিয়ারদের নামের পাশ থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। আন্দোলনে সামিল হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারদের একটা বড় অংশ কর্মচ্যুত হন।
মূলত স্থায়ী নিয়োগপত্র দেওয়া, ন্যূনতম মজুরি দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষার দাবিতেই আন্দোলন করছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের সংগঠন। রাজ্য চাপ বাড়ালেও তাঁরা আন্দোলন থেকে সরেননি। রাজ্য পুলিশও তাঁদের দমাতে বারবার সভা করায় বাধা দিতে শুরু করে। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বাসিন্দা প্রাক্তন সিভিক ভলান্টিয়ার বাপি পাল নামে এক যুবক সম্প্রতি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কটূক্তি করার পরে গ্রেফতার হন। বিনা অনুমতিতে সমাবেশের চেষ্টা করা হচ্ছে অভিযোগে মালদহে সিভিক ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি সঞ্জয় পড়্যা-সহ ৫৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এই প্রেক্ষিতেই বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর সুর বদল নিয়ে পাল্টা সুর চড়িয়েছেন। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “ওঁর কথার কোনও দাম নেই। এই ক’দিন আগেই সিভিক পুলিশদের চাকরি খেলেন। এখন আবার বলছেন, কারও চাকরি যাবে না!” এক ধাপ এগিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন সিভিক ভলান্টিয়ারদের সতর্ক করেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বিশ্বাস করলে বিপদ হবে!”
সিভিক ভলান্টিয়ারদের সংগঠনের নেতারাও এ দিন বার-বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, চাকরি হারানোর পর থেকে কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁদের। সংগঠনের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি মিলন গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, “সরকারের তরফে বার বার হুমকি দেওয়া হয়েছে আমাদের। প্রাক্তন সহকর্মীদের বলা হয়েছে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের দোরে-দোরে ঘুরে কোথাও কোনও আশার কথা শুনিনি।”
সংগঠনের নেতাদের প্রশ্ন, এখন কেন সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাছে টানতে চাওয়া হচ্ছে? তাঁদের বিশ্লেষণ, “একেই সারদা-কাণ্ড নিয়ে এখন কোণঠাসা তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার। তার উপরে সামনে বেশ কিছু পুরসভার ভোট রয়েছে। তার পরে আছে বিধানসভার ভোট। সে সব মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী সিভিক ভলান্টিয়ারদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।” সংগঠনের সভাপতি সঞ্জয় পড়্যার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিতে পারেন। তবে আমরা থামছি না। হাইকোর্টে মামলা করেছি। সেই আইনি লড়াই চলছে। আন্দোলনও যেমন চলছে, তেমন চলবে।”