মঙ্গলবার হঠাৎই বিধানসভায় হাজির তিনি। এবং মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই ঢিপ করে প্রণাম! যা দেখেশুনে দল এবং বিরোধীদের প্রায় সকলেই বলছেন, আরাবুল আছেন আরাবুলেই।
গত বছর ভাঙড়ে দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে দুই কর্মী খুন হওয়ার পরে ভাঙড়ের এই প্রাক্তন বিধায়ককে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার করেছিল তৃণমূল। ঢাকঢোল পিটিয়ে তা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদ থেকে কোনও দিনই তাঁকে সরানো হয়নি। এলাকায় তাঁর দাপট কমেনি। স্থানীয় কলেজেও প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রেখেছিলেন তিনি। এমনকী, তাঁর পিতৃবিয়োগের পরে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। এলাকায় তৃণমূলের কর্মীরাও বরাবরই দাবি করে এসেছেন, আরাবুলদা যেমন ছিলেন তেমনই আছেন! মঙ্গলবারের ঘটনা সবার সেই দাবিকেই যেন আরও স্পষ্ট করে দিল। বিশেষ কোনও কারণ ছাড়া এ দিন বিধানসভায় আসেন আরাবুল। তার পরে যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। যা দেখে বিরোধীরা বলছেন, এর থেকেই বোঝা গেল, তৃণমূলের শাস্তি কতটা ঠুনকো!
আর আরাবুল? তিনি বললেন, “দিদি আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছেন। আমি দিদিকে খুব ভালোবাসি। দিদির জন্যই তো আমি আরাবুল ইসলাম হয়েছি! দিদিই আমাকে তৃণমূলের টিকিট দিয়েছিলেন, তাই আমি বিধায়ক হয়েছিলাম।”
গত বছর ভাইফোঁটার দিন দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরে দুই তৃণমূল নেতা খুন হয়েছিলেন ভাঙড়ে। ওই খুনের ঘটনায় আরাবুলের উস্কানি রয়েছে বলে দলের অন্দরেই অভিযোগ উঠেছিল। তার জেরেই দলীয় শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির সুপারিশে আরাবুলকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে সরানো হয়নি তাঁকে। আরাবুল-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, মুকুল রায় অতি সক্রিয় হওয়ার ফলেই আরাবুলকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়।
তৃণমূলের অন্দরে আরাবুল বরাবরই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ এবং মুকুল রায়ের বিরোধী বলে পরিচিত। পার্থবাবুকে নিজের গুরু বলে প্রকাশ্যেই বিবৃতি দিয়েছিলেন তিনি। অনেকেই বলছেন, তৃণমূল থেকে মাসচারেক আগে বহিষ্কৃত আরাবুল যখন দেখেছেন শাসক দলে মুকুল-যুগ প্রায় শেষ, তখনই নিজের জন্য ফের রাস্তা খোলার চেষ্টা চালিয়েছেন। ঠিক যে ভাবে দলনেত্রীর বৃত্তে ফিরে এসেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, বা বিদ্রোহী ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছেন অর্জুন সিংহ। এঁরা সকলেই মুকুল-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। আরাবুল-ঘনিষ্ঠ এক জেলা তৃণমূল নেতার কথায়, “দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মুকুল রায়ের স্নেহভাজন বহু নেতা রয়েছেন। এখন দলে মুকুলদা সব পদ হারিয়ে কোণঠাসা। তবে জেলার একাধিক নেতার সঙ্গে মুকুলদার যোগাযোগ আছে। দাদাও (আরাবুল) এই সময় দিদির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।”
এমন নয় যে, তৃণমূলের সর্ব স্তরের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আরাবুলের। বরং, স্বয়ং দলনেত্রীর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় তাঁর মাথার উপরে আছে বলেই তৃণমূলের একাংশের মত। যে কারণে বহিষ্কারের পরেও ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদ থেকে আরাবুলকে সরানো হয়নি। আরাবুলও দলের বহু নেতার সঙ্গে তলায় তলায় সম্পর্ক রেখে গিয়েছেন।
আরাবুল অবশ্য জানাচ্ছেন, বিধায়কের পেনশন সংক্রান্ত কাজে এ দিন বিধানসভায় যান তিনি। অধিবেশন চলছে বলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হতে পারে। তাই ভিতরেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরের ব্যাখ্যা বলছে, আচমকা নয়। রীতিমতো অঙ্ক কষেই এই সময়ে বিধানসভায় যান আরাবুল।
জেলা তৃণমূলের একাংশ বলছে, দলনেত্রীর আশীর্বাদ নিতে গিয়ে আরাবুল এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, মুকুল-হীন জমানায় দলে সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার লক্ষ্য আছে তাঁর। আর দ্বিতীয়ত, ভাঙড়ে তাঁর বিরোধী এবং মুকুল-ঘনিষ্ঠ কিছু নেতাকে কোণঠাসা করার ভাবনাও আরাবুলের আছে। তাই দিদিকে প্রণাম! যা দেখে এক বিরোধী বিধায়কের মন্তব্য, “কখনও মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায়, কখনও পার্থ-শিষ্য আরাবুল ইসলাম! তৃণমূলে প্রণামও দেখছি একটা রাজনীতি!”