স্বামীজি এবং নেতাজির সঙ্গে চাই মমতাজিও! জারি হয়েছে সরকারি ফরমান!
আসন্ন দুই উৎসবে দুই মনীষীর সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি রাখতে হবে বলে জেলায় জেলায় পৌঁছে গিয়েছে সরকারি নির্দেশিকা। তাতে তুমুল বিতর্ক বেঁধেছে বুঝেও তা প্রত্যাহার করতে পারছে না রাজ্যের যুব কল্যাণ দফতর। নির্দেশিকা প্রত্যাহার করলে যদি ‘দিদি’ কুপিত হন! তাই তারা আপাতত হাত গুটিয়ে। জল গড়াচ্ছে নিজের মতো!
দলীয় অনুষ্ঠান তো বটেই, সরকারি অনুষ্ঠান মঞ্চেও হরবখত শোভা পায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। তৃণমূলের আমলে সেটাই দস্তুর। কিন্তু এ বারের সরকারি নির্দেশিকার অর্থ, মনীষীদের জন্মোৎসব পালনের সরকারি মঞ্চেও মনীষীদের ছবির সঙ্গে দেখা যাবে মমতার ছবিও। যার জেরে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে, দিদি কি মনীষী? নাকি সারদা-কাণ্ডের ছায়া থেকে বেরোতে মনীষীদের মাহাত্ম্যে ভাগ বসাতে চাইছেন?
আগামী জানুয়ারিতেই দুই মনীষীর জন্মদিন। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে ১১ ও ১২ জানুয়ারি রাজ্য জুড়ে পালিত হবে ‘বিবেক চেতনা উৎসব’। আর সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে ২২ ও ২৩ জানুয়ারি পালন করা হবে ‘সুভাষ উৎসব’। দুই অনুষ্ঠানেরই আয়োজক যুব কল্যাণ দফতর। রাজ্যের প্রতিটি ব্লক, পুর এলাকা, কলকাতা পুর নিগমের প্রতিটি বরো এবং জেলা স্তরে এই দুই উৎসব পালনের জন্য যুব কল্যাণ দফতরের নির্দেশিকায় স্পষ্ট জানানো হয়েছে, জনবহুল এলাকায় ৩০ ফুট বাই ১০ ফুট মাপের মঞ্চ বানাতে হবে। মঞ্চের পিছনে ১০ ফুট বাই ৩ ফুট মাপের ফ্লেক্স-ব্যানারে সংশ্লিষ্ট মনীষীর ছবির সঙ্গে রাখতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর ছবিও। অর্থাৎ ‘বিবেক চেতনা’ উৎসবে স্বামীজি এবং ‘সুভাষ উৎসবে’ নেতাজির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি পাশাপাশি শোভা পাবে! ‘বিবেক উৎসবের’ জন্য প্রতিটি জেলাকে ৩০ হাজার এবং ‘সুভাষ উৎসবের’ জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলেও নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে।
সরকারি ভাবে ‘সুভাষ উৎসবের’ আয়োজন এ বার প্রথম হলেও ‘বিবেক উৎসব’ গত কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। মনীষীদের ছবির পাশে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি রাখার সরকারি নির্দেশিকা অবশ্য তৃণমূল জমানায় নতুন নয়। ২০১২ সালে ব্লক ও পুরসভা স্তরে ‘রাখিবন্ধন উৎসব’ পালনের জন্য যুব কল্যাণ দফতরের নির্দেশিকাতেও বলা হয়, মঞ্চের ফ্লেক্সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি রাখতে হবে। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সরকার যখন কোণঠাসা, তখন এ ভাবে মনীষীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি রাখার নয়া নির্দেশ নয়া বিতর্ক বয়ে এনেছে।
বিভিন্ন পণ্যের বিপণনে তারকা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামীদামি ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করা বিজ্ঞাপন জগতের চেনা কৌশল। তারকাদের নিজস্ব আবেদন সেই পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কাজে লাগানো হয়। এই উদাহরণ দেখিয়েই সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী হয়তো চাইছেন, দুই মনীষীর পাশাপাশি নিজের ছবি রেখে তাঁদের আলোয় আলোকিত হবেন! কিন্তু মনীষা তো ট্রান্সফার হয় না!” বিজেপি নেতা রীতেশ তিওয়ারির কথায়, “সারদার সঙ্গে ওঁর দলের যোগাযোগ এখন মানুষের কাছে জলের মতো স্পষ্ট। মনীষীদের সঙ্গে ছবি রেখে উনি গায়ের কালি তুলতে পারবেন না!”
নেতাজির প্রতিষ্ঠিত দল ফরওয়ার্ড ব্লক এই নির্দেশিকা কার্যকর করার প্রতিবাদে জেলায় জেলায় বিক্ষোভে নামবে। দলের যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক আব্দুর রউফ বৃহস্পতিবার বলেন, “দুর্নীতি ঢাকার জন্য মনীষীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী নিজের ছবি লাগাতে চাইছেন! আমরা মেনে নেব না।” কলকাতায় সোমবার যুব লিগের সমাবেশ থেকে এই মর্মে প্রতিবাদ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করার কথা ফব-র প্রবীণ নেতা অশোক ঘোষের।
ঘটনাচক্রে, দিদির ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিবেকানন্দের নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বিবেক’কে নিয়ে নেতাজির জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণার দাবিতে পথে নেমেছেন, তখনই মুখ্যমন্ত্রী সরকারি ভাবে স্বামীজি-নেতাজির সঙ্গে এক বন্ধনীতে ঢুকতে চাইছেন! কার্তিক অবশ্য এই উদ্যোগে আপত্তিকর কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, “যে হেতু সরকারি ব্যাপার, সেই কাজের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি থাকতেই পারে।” কিন্তু নেতাজি বা স্বামীজির মতো মনীষীর মহত্বের আলোয় আলোকিত হতেই কি মুখ্যমন্ত্রীর ছবির ব্যবহার? কার্তিক বলেন, “এটা ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে নির্ভর করছে। এই নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই।” বিরোধীরা অবশ্য বলছে, দিদির পরিবারের অংশ হয়ে আপত্তির কথা বলা সম্ভবও নয়!
কী বলছে সরকার? যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এই নিয়ে কোনও মন্তব্যে নারাজ। তবে সরকারি সূত্রের বক্তব্য, অতীতের ছাত্র-যুব উৎসবের নির্দেশিকার ফরমানেই নেতাজি-স্বামীজির নাম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বিড়ম্বনায় পড়েছে সরকারই! এক সরকারি আধিকারিকের কথায়, “এখন না যাচ্ছে গেলা, না যাচ্ছে ওগরানো! বিতর্ক বুঝে নির্দেশিকা তুলে নিলে মুখ্যমন্ত্রী যদি জবাবদিহি চান!”
‘মনীষী’ দিদির নির্দেশ না পেলে নির্দেশিকা তাই বহাল থাকছে!