কারখানার গেটে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’ নোটিস ঝুলেছে পাঁচ মাস আগেই। এ বার হিন্দমোটরে সাঁটা হল স্বেচ্ছাবসরের বিজ্ঞপ্তি।
কারখানা বন্ধের পরে দু’এক বার অল্প হলেও বকেয়া পেয়েছিলেন শ্রমিকেরা। রাজ্য সরকারের তরফে সাহায্যের আশ্বাসও ছিল। সব মিলিয়ে কিছুটা হলেও তাঁরা আশায় ছিলেন। ঠিক সেই সময়েই স্বেচ্ছাবসরের নোটিসে শ্রমিকেরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। একাংশ আন্দোলনে নামার কথা ভাবছেন। আর এক অংশ হয় হতাশ, অন্যথায় দোটানায় ভুগছেন।
সোমবার দিনভর এটাই ছিল দেশের প্রথম মোটরগাড়ি কারখানা হিন্দুস্তান মোটরসের চিত্র। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে রবিবার বিকেলেই। আগামী ২০ নভেম্বর পর্যন্ত কারখানার অফিস থেকে ফর্ম দেওয়া চলবে। কর্তৃপক্ষের ঘোষণা, স্বেচ্ছাবসর নিলে পাওনাগন্ডা ছাড়াও এককালীন এক লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। লোকসানে চলা কারখানাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু অনেকেই সেই যুক্তি বিশ্বাস করছেন না।
শ্রমিকদের একাংশের সন্দেহ, এই ঘোষণার পিছনে রাজ্যের মদত আছে। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক মুখ খুলতে চাননি। তবে শ্রম দফতরের পরিষদীয় সচিব তপন দাশগুপ্ত বলেন, “রাজ্যকে না জানিয়েই কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকার আলোচনায় বসবে।” এ দিন কিছু শ্রমিক কারখানার অফিস থেকে স্বেচ্ছাবসরের ফর্ম তোলেন। আবার আইএনটিইউসি এবং এসএসকেইউ এই নিয়ে আন্দোলনে নামবে বলে জানিয়েছে। তবে তপনবাবু বলেন, “স্বেচ্ছাবসর নেওয়া তো বাধ্যতামূলক নয়। যাঁরা চাইবেন, নিতে পারেন।”
সত্যি বলতে, স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার ব্যাপারে শ্রমিকেরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। কারখানার ‘ফর্জ শপ’ বিভাগের শ্রমিক পার্থ ময়রার এখনও ১২ বছর চাকরি রয়েছে। তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “সারা জীবনের জন্য মোটে এক লক্ষ! ওই টাকা আমার চাই না।” ওই বিভাগের কর্মী মলয় মাঝির গলায় সংশয়, “দু’বছর চাকরি আছে। অবসর নিলেও কর্তৃপক্ষ সত্যিই পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেবে, গ্যারান্টি কোথায়?”
নিরাপত্তারক্ষী রামকৃষ্ণ দে ফুঁসে ওঠেন, “চূড়ান্ত বেআইনি সিদ্ধান্ত এটা! ছ’বছর আগেও একই চেষ্টা হয়েছিল। তখন আন্দোলন করায় ৫২ জনকে বদলি হতে হয়। আমিও ছিলাম সেই তালিকায়। কিন্তু চাকরি বাঁচিয়েছিলাম। এ বারও আমাদের তাই করতে হবে।” এসএসকেইউ নেতা আভাস মুন্সি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত আসলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের নামান্তর। আমরা আগেও আন্দোলন করেছি। ফের পথে নামব। অবিলম্বে বেআইনি বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করা হোক।” আইএনটিইউসি নেতা কামাখ্যা সিংহেরও একই দাবি।
তবে আইএনটিটিইউসি নেতা উত্তম চক্রবর্তী জানান, তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না। কারখানার ‘প্রোডাকশন’ বিভাগের শ্রমিক আশিস চক্রবর্তীর মতে, “যে ভাবে একটার পর একটা শ্রমিক-বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রোমোটারি বা হাইটেক সিটি-র জন্যই চক্রান্ত চলছে।” বিজয়শঙ্কর তিওয়ারি নামে এক শ্রমিকের প্রশ্ন, “ম্যানেজমেন্ট, সরকার, ইউনিয়ন কার উপরে ভরসা রাখব? ১৯৯৬ থেকে একই নাটক দেখছি। এই বয়সে কে চাকরি দেবে?” বিপর্যয় দেখতে দেখতে কিছু শ্রমিক আশা হারিয়ে বসেছেন। যেমন, দিলীপকুমার সিংহ নামে এক শ্রমিক বলেন, “৩৪ বছর এখানে কাজ করেছি। ক্রমেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না। যেটুকু পাই, সেটাই লাভ। পরে যে এটুকুও পাব, তার নিশ্চয়তা কোথায়?” সাড়ে তিন দশক কাজ করার পরে এ দিন স্বেচ্ছাবসরের ফর্ম তুলতে লাইনে দাঁড়ান শ্রীরামপুরের বাসিন্দা অশোক পাল। তাঁর কথায়, “কী আর করব! আমরা অসহায়। আমি হিন্দমোটরের শ্রমিক। কিন্তু আজ ফুল বেচে পেট চালাতে হয়!” গলা বুজে আসে তাঁর।