সাকিন থেকে সম্পত্তি, রহস্যে ঘেরা শঙ্কুদেব

ছিলেন সাংবাদিক। আচমকা ভোল পাল্টে চলে এলেন রাজনীতিতে, ‘পিসি’র ডাকে সাড়া দিয়ে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে রাজ্যের ছাত্র-রাজনীতি তথা তামাম শিক্ষার আঙিনায় অনন্য পরাক্রমে ছড়ি ঘোরালেন। তাঁর ভয়ে কাঁপলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরা। পেশা-জীবনে এ হেন উল্কাসদৃশ উত্থানের পাশাপাশি ‘বৈষয়িক’ ক্ষেত্রেও শঙ্কুদেব পণ্ডার তাক লাগানো পরিবর্তন নিয়ে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) খোঁজ-খবর শুরু করেছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১১
Share:

কাঁথির আঠিলাগোড়িতে শঙ্কুদেবের বাড়ি।—নিজস্ব চিত্র।

ছিলেন সাংবাদিক। আচমকা ভোল পাল্টে চলে এলেন রাজনীতিতে, ‘পিসি’র ডাকে সাড়া দিয়ে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে রাজ্যের ছাত্র-রাজনীতি তথা তামাম শিক্ষার আঙিনায় অনন্য পরাক্রমে ছড়ি ঘোরালেন। তাঁর ভয়ে কাঁপলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরা। পেশা-জীবনে এ হেন উল্কাসদৃশ উত্থানের পাশাপাশি ‘বৈষয়িক’ ক্ষেত্রেও শঙ্কুদেব পণ্ডার তাক লাগানো পরিবর্তন নিয়ে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) খোঁজ-খবর শুরু করেছে।

Advertisement

তৃণমূলের প্রাক্তন ছাত্রনেতা তথা অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেবের নাম জড়িয়েছে সারদা কেলেঙ্কারিতে। ঘটনায় তাঁর ভূমিকা যাচাই করতে গিয়ে ইডি-র তদন্তকারীদের প্রথম নজর কেড়েছে যেটা, তা হল, সাধারণ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক থেকে রাজনীতির পাণ্ডা হয়ে ওঠা। ইডি-সূত্রের খবর: পেশা বদল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ‘পিসি’ অর্থাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম টেনে আনেন শঙ্কু। তদন্তকারীদের জানান, তৃণমূলনেত্রীর নির্দেশেই তাঁর রাজনীতিতে পদার্পণ।

গ্রেফতার হওয়ার পরে ভরা এজলাসে সারদার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের নাম ‘কৌশলে’ টেনে এনেছিলেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদার। অন্য দিকে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের অভিযোগ, সিবিআই তাঁর মুখ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলিয়ে নিতে চাইছে। এ বার ইডি’র জেরার মুখে পড়ে শঙ্কুদেবও ‘পিসি প্রসঙ্গ’ টেনে এনে ঘুরপথে তৃণমূলনেত্রীর নাম সারদায় জড়িয়ে দিলেন কিনা, সে জল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শঙ্কু সারদা-কাণ্ডে নিজের নামটি জড়ালেন কী ভাবে?

Advertisement

ইডি-সূত্রের ব্যাখ্যা: শুভাপ্রসন্নর মালিকানাধীন ‘এখন সময়’ চ্যানেলে অন্যতম শীর্ষ পদে শঙ্কুদেব কাজ করতেন। বেতন হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকাও নিতেন বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে এ সবই তিনি অস্বীকার করেছেন, যার ফলে ঘোর রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইডি’র দাবি, ওই চ্যানেলে শঙ্কুর কাজ করা নিয়ে তদন্তকারীদের সংশয় না-থাকলেও ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি ঘেঁটে ‘দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেড’ (চ্যানেলটির মালিক সংস্থা)-এর সঙ্গে কোনও লেনদেনের তথ্য এখনও মেলেনি। এবং এরই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি শঙ্কু নগদ টাকায় বেতন নিতেন? নিয়ে থাকলে সে টাকা দিয়ে তিনি কী করেছেন?

সত্য উদ্ঘাটনের তাগিদে শঙ্কুদেবের বিষয়-সম্পত্তি সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথম ধাপেই ইডি’কে হোঁচট খেতে হয়। কারণ, ওঁর নিবাস ঘিরেই দুস্তর বিভ্রান্তি! এক তদন্তকারীর কথায়, “ওঁর ঠিকানা নিয়েই তো ধোঁয়াশা! কলকাতায় কোথায় থাকেন, সেটাই সোজা-সাপ্টা বলতে পারেননি!” ইডি’র অন্দরের খবর: জেরায় শঙ্কু জানিয়েছেন, তাঁর আদি বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি শহরে, পরিবার সেখানেই থাকেন। কিন্তু নিজের কলকাতার ঠিকানা জানাতে গিয়ে থতমত খেয়ে যান দাপুটে নেতা। খানিক বাদে বরাহনগর-বেলঘরিয়া অঞ্চলের একটা ঠিকানা দেন। তার অস্তিত্ব অবশ্য বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে তদন্তকারীদের দাবি। তা হলে উনি কলকাতায় আদতে থাকেন কোথায়?

ইডির একাংশের বক্তব্য: তৃণমূলের এক সূত্র মারফত তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০১১-র বিধানসভা ভোটের মুখে শঙ্কু ইএম বাইপাসে তৃণমূল ভবনের তিনতলার একটি ঘরে এসে ডেরা বাঁধেন। এখনও সেটাই তাঁর আস্তানা। যে কারণে কয়েক দিন আগে শঙ্কুকে তলবের নোটিস ধরাতে ইডি-অফিসারেরা তৃণমূল ভবনে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তদন্তকারীদের দাবি, শঙ্কু তাঁদের সামনে মানতে চাননি যে, তিনি তৃণমূল ভবনে থাকেন। “তবে জোর দিয়ে অস্বীকারও করেননি। যে ভাবে না বলেছেন, তাতে তেমন প্রত্যয় ছিল না।” মন্তব্য এক তদন্তকারীর। যিনি জানাচ্ছেন, অন্যত্র বসবাসের পর্যাপ্ত কোনও প্রমাণও শঙ্কুদেব ইডি’র সামনে দাখিল করতে পারেননি।

সাকিন প্রকাশের ব্যাপারে এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখে ইডি-র অফিসারেরা ধন্দে পড়েছেন। একই ভাবে শঙ্কুদেবের আদি বাড়ির নজরকাড়া পরিবর্তনে কাঁথির আঠিলাগোড়ির অনেক লোকও বিস্মিত। আঠিলাগোড়ির সাতমাইলে শঙ্কুর পৈতৃক বাড়ি। তাঁর বাবা মৃগাঙ্ক পণ্ডা অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি পরিবহণ-কর্মী। বছর দশেক আগে পর্যন্ত তাঁরা ওখানকার একটি দোতলা বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন। বাড়িটির মালিক রন্তিদেব দাস বলেন, “মৃগাঙ্কবাবু ২০০৫-এ বাড়ির একটা অংশ স্ত্রীর নামে পাঁচ লাখ টাকায় কিনে নেন। ২০১২-য় ওঁদের অংশটি আপাদমস্তক সংস্কার করা হয়। আর ওই বছরই ওঁরা তিনতলা বানিয়ে নিয়েছেন।”

গত তিন বছরে বাড়ির একাধিক ঘরে এসি মেশিন বসেছে। ঘরে ঘরে ঠাসা দামি আসবাব। বস্তুত শঙ্কুদেবের বাড়িতে বিলাস-ব্যসনের নানাবিধ আয়োজন পাড়া-পড়শির চোখ ধাঁধিয়েছে। প্রশ্নও উঠছে। “মৃগাঙ্কবাবু ছিলেন মামুলি পরিবহণ-কর্মী। শঙ্কুর কত টাকা রোজগার ছিল যে, এত সব করতে পারে?” কটাক্ষ এক বাসিন্দার। ইডি-সূত্রের দাবি: দক্ষিণ কলকাতার কিছু সম্পত্তিতেও শঙ্কু-যোগের প্রাথমিক তথ্য তাদের হাতে এসেছে। সে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি দেখা হচ্ছে, আঠিলাগোড়ির বাড়ির সংস্কার কিংবা তিনতলা তৈরির সময়ে ইমারতি সামগ্রী কোথা থেকে এসেছিল, সে বাবদ কোথা থেকে কত টাকা খরচ করা হয়েছে, ইত্যাদি।

শঙ্কুদেব নিজে কী বলেন?

এ দিন ওঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। এসএমএস করা হলে তারও জবাব তিনি দেননি। ওঁর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতা অবশ্য বলেছেন, “বিশ বছর ধরে শঙ্কুরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়েই তার একটা অংশ কিনে নিয়েছেন। ইডি তো শঙ্কুর টাকার উৎস সম্পর্কে তদন্ত করছে! তদন্তেই সব তথ্য পেয়ে যাবে।” তৃণমূলের আর এক নেতার মন্তব্য, “ইডি আসলে তদন্তে কিছু পায়নি। তাই এখন সিবিআই-কে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে শঙ্কুর বিরুদ্ধে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement