এক ক্লাবকর্তার হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: প্রদীপ আদক।
শুক্রবার সরকারি কর্মীদের ৭% মহার্ঘভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তিনি বলেছিলেন, রাজ্যের কোষাগারে টাকা নেই। চব্বিশ ঘণ্টা না-পেরোতেই শনিবার বিভিন্ন জেলার সাত হাজার ক্লাবকে ১০৫ কোটি টাকা খয়রাতি করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন সাড়ে তিন হাজার ক্লাব পেল পেল ২ লক্ষ টাকা করে। বাকিদের প্রাপ্তি এক লক্ষ। এই নিয়ে ২০১২ থেকে এ পর্যন্ত শুধু ক্লাবের পিছনে সরকারের খরচ হল প্রায় ২২৫ কোটি টাকা।
খয়রাতি পাওয়ার তালিকার ক্লাবগুলিকে বাছাই করেছেন তৃণমূলের বিধায়ক ও পুরসভার কাউন্সিলররা।
ক্লাবগুলিকে টাকা দেবেন বলে এ দিন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক ঝাঁক পারিষদকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্লাবকর্তাদের হাতে চেক তুলে দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “ক্লাবের ছেলেরাই আমাদের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে।” এবং এই কাজের জন্য জেলবন্দি ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র ও যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ঢালাও প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রত্যাশিত ভাবেই এ ভাবে সরকারি টাকা খরচ করার প্রবল সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, টাকার অভাব দেখিয়ে উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ কাটছাঁট করা হচ্ছে, সরকারি কর্মীদের ডিএ বাবদ প্রাপ্য বকেয়া মেটানো হচ্ছে না। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর মন রাখতে সেই কোষাগার থেকেই ফি-বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এ তো তুঘলকি শাসন চলছে! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “এ ভাবে সরকারি অর্থে দানছত্র খোলা যায় না। সরকারের টাকা কোনও রাজনৈতিক দলের তহবিল হতে পারে না।” মমতা কেন ক্লাবগুলোকে টাকা দিচ্ছেন? অধীরের ব্যাখ্যা, “সারদার টাকা এখন পাওয়া যাবে না। অথচ সামনে পুরসভা ও বিধানসভা ভোট। সেই ভোটের খরচ আসবে কোথা থেকে? অতএব, মানুষের মন পেতে সরকারি অর্থে ক্লাবগুলোকে খরিদ করা হচ্ছে।” বিজেপির রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারি বলেন, “পুরভোটে দলের হয়ে ক্লাবের ছেলেদের নামাতেই এই খয়রাতি।” তাঁর দাবি, “সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় বিপর্যস্ত দল। কর্মীদের মনোবলও ভেঙে পড়ছে। তাই লোক ধরে রাখতে ওরা টাকা ওড়াচ্ছে।”
এ বার অনুদান প্রাপকের তালিকায় ছিল কলকাতা পুর এলাকার প্রায় ১০৫০ ক্লাব। পুরসভার একাধিক কর্তা জানান, দিন কয়েক আগে ১০৭ জন তৃণমূল কাউন্সিলরকে ক্লাব বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাত্র সাত দিনের মধ্যে তাঁদের তালিকা দিতে বলা হয়। অনেকেরই ধারণা, খুব দ্রুততার সঙ্গে ক্লাব বাছাই করতে গিয়ে বিস্তর ভুয়ো নাম ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
রাজ্য ক্রীড়া দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, কোনও ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার আগে তাদের নথিভুক্ত হওয়ার শংসাপত্র, তিন বছরের অডিট রিপোর্ট এবং সাধারণ সভার বিবরণী, নিজস্ব জমি এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র-সহ বেশ কিছু নথি দেখে নেওয়ার কথা। পরবর্তী অনুদানের ক্ষেত্রে আগের বারে পাওয়া অর্থ কী ভাবে খরচ হয়েছে, তার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ (ইউসি) দেখানোর নিয়ম। কিন্তু বারবারই অভিযোগ উঠেছে, এই সব নিয়মের তোয়াক্কা না-করে শুধুমাত্র বিধায়ক ও কাউন্সিলরদের সুপারিশের ভিত্তিতেই ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ইউসি-ও খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা নেই। যদিও নবান্নের দাবি, ক্লাবের দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখতে ২০১৩ সালেই একটি পৃথক কমিটি তৈরি করা হয়েছে। তবে তার কোনও প্রতিফলন কাজে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ।
অথচ বেহিসেবি খরচ, আর তা সামাল দিতে প্রতি মাসে টাকা ধার করার সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের (পিএজি) দফতর। তারা দেখিয়েছে, বাজেট বরাদ্দের মাত্র ২৭% পরিকল্পনা খাতে রেখেছে রাজ্য। তার মধ্যেও আবার মেলা-খেলা-উৎসব-পুরস্কার, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা, সৌন্দর্যায়ন, নীল-সাদা রঙ করানো, হাজার হাজার ক্লাবকে টাকা বিলোতেই বিস্তর খরচ হচ্ছে। যা থেকে রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি কোনও লাভই হবে না।
বস্তুত, গত তিন বছর অনুদান পাওয়া ক্লাবগুলির দেওয়া তথ্যই বলছে, খেলাধুলোর উন্নয়নে ওই টাকা খরচ করেনি তারা। যেমন, গড়িয়ার একটি ক্লাব অনুদানের টাকা দিয়ে ক্লাববাড়ি দোতলা করেছে। বিয়েবাড়ি হিসেবে ভাড়া দিয়ে ক্লাবের নিয়মিত রোজগারের রাস্তা করতেই দোতলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্লাব-কর্তারা। অথচ, পাশের পাড়ার একটি ক্লাবে নিয়মিত খেলাধুলোর চর্চা হলেও তারা এখনও সরকারের অনুদান থেকে বঞ্চিত। জঙ্গলমহলের কয়েকটি ক্লাব জানিয়েছে, অনুদানের টাকায় তারা গ্রামের রাস্তা তৈরি করেছে। আবার, নদিয়ার কয়েকটি ক্লাব অনুদানের টাকায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স কিনে তা ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে।
এই খয়রাতিতে খেলাধুলার মান বাড়ছে কি না, তা নিয়ে এ দিন একটি শব্দও খরচ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “ছোট্ট ছোট্ট ছাত্র যৌবন। কখনও তারা দুর্গাপুজো, কখনও কালীপুজো, কখনও বা ঈদ, বড়দিনের উৎসবে মেতে ওঠে। মাল্টিজিম, বিচিত্রানুষ্ঠান করে। ওই সব ভাইবোনেরা আমাদের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে।”