লক্ষ্মণ-পর্বে আলিমুদ্দিনের বিড়ম্বনার পাশাপাশি এ বার বেজায় চাপে পড়ল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএম! লক্ষ্মণ শেঠ না আলিমুদ্দিন কোন দিকে যাবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদেরই!
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে লক্ষ্মণ-অনুগামীদের সংখ্যা এখনও যথেষ্ট। তমলুকের প্রাক্তন সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দল-বিরোধী কাজের অভিযোগে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য নেতৃত্বের উপরে পাল্টা চাপ সৃষ্টির জন্য সক্রিয় হয়েছেন তাঁরাই। এর মধ্যে বুধবার তমলুকে লক্ষ্মণ-অনুগামীদের হাতে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্য রবীন দেব, মৃদুল দে ও নৃপেন চৌধুরীর হেনস্থার ঘটনায় প্রত্যাশিত ভাবেই ক্ষুব্ধ আলিমুদ্দিন। সেই ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ভার দলের গঠনতন্ত্র মেনে জেলা নেতৃত্বের হাতেই ছেড়েছে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে বিভক্ত জেলা নেতৃত্ব যার ফলে পড়েছেন আরও সঙ্কটে! তাঁদের এখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা!
পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে পূর্ব মেদিনীপুর সিপিএমের ‘অবসৃত’ জেলা সম্পাদক কানু সাহু (২৪ ঘণ্টা আগেই অবশ্য তিনি বিমান বসুকে চিঠি দিয়ে নিজের সাময়িক ভাবে সরে যাওয়ার আবেদন তুলে নেন) ও ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্ত প্রধানের দ্বৈরথ! আলিমুদ্দিনে এসে এ দিন প্রশান্তবাবু মঙ্গলবারের ঘটনার বিবরণ রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়ে গিয়েছেন। বিক্ষোভ ও হেনস্থার ঘটনায় সামিল ৩৫-৪০ জনকে তিনি প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিতও করে গিয়েছেন। সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত, লক্ষ্মণবাবুর অঙ্গুলি হেলনেই জেলায় তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারা ওই ঘটনার পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। এই খবর পেয়ে প্রশান্তবাবুর এক্তিয়ারকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন কানুবাবু! তাঁর দাবি, প্রশান্তবাবু যে ভাবে রিপোর্ট দিয়েছেন, তা বেআইনি ও দল-বিরোধী! কানুবাবুর বক্তব্য, “১৬ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে প্রশান্তবাবুকে অস্থায়ী সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলের রাজ্য নেতৃত্বকে যদি কোনও রিপোর্ট দিতে হয়, তা হলে সেই রিপোর্ট প্রথমে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে। তার পরে জেলা সম্পাদক অর্থাৎ আমি সেই রিপোর্ট দলের রাজ্য সম্পাদকের কাছে জমা দেব।”
ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক প্রশান্তবাবুর আবার পাল্টা দাবি, “আমি কোনও রিপোর্ট দিইনি। নিজের চোখে ঘটনা যা দেখেছি, যাদের দেখেছি, সে সব রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছি।” তারা কারা, তা অবশ্য ভাঙতে চাননি তিনি। তবে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত, কলকাতায় লক্ষ্মণবাবুর ফ্ল্যাটে বসে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারা যে তদন্ত কমিটির সদস্যদের শিক্ষা দেওয়ার ছক করেছিলেন, তা-ই জানানো হয়েছে আলিমুদ্দিনকে। যার প্রেক্ষিতে কানুবাবুর আবার পাল্টা মন্তব্য, “কারা যুক্ত ছিল, তা চিহ্নিত করতে হলে দলে তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের রিপোর্ট না পেলে কাউকে চিহ্নিত করে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না!”
তমলুকে নিগৃহীত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীনবাবু এ দিন বলেছেন, “কী ঘটনা ঘটেছে, তা দল তদন্ত করে দেখছে। আমি সেখানে সভা করতে গিয়েছিলাম, হয়তো কিছু ভুল বার্তা গিয়েছিল।” আবার লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ আর এক নেতা
অমিয় সাহু এ দিনই তমলুকে সিটুর নির্মাণকর্মী ইউনিয়নের সভা থেকে মন্তব্য করেছেন, সংগঠনের বর্তমান জেলা সম্পাদক লক্ষ্মণবাবুই আগামী দিনে তাঁদের নেতৃত্ব দেবেন।
লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কানুবাবু ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক ডেকেছেন। সেই বৈঠকে তাঁর উল্টো শিবিরের নেতারা যাবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়! পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, আড়াআড়ি বিভাজনের চোটে গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলী ভেঙে দেওয়ার আপৎকালীন সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে আলিমুদ্দিনকে। দু’দিন পরেই বৈঠকে বসছে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী।
এর মধ্যে এ দিন সন্ধ্যায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে একসঙ্গে দেখতে গিয়েছিলেন লক্ষ্মণবাবু এবং সিপিএমের বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ! যে ঘটনায় নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে, তা হলে কি তলে তলে সিপিএমের অন্দরে বড় কোনও ঘটনার প্রস্তুতি চলছে? সুশান্তবাবু অবশ্য এই ঘটনার মধ্যে কোনও তাৎপর্য খুঁজে পাওয়ার কারণ দেখছেন না। তাঁর দাবি, তাঁর কাছে কোনও গাড়ি ছিল না বলে লক্ষ্মণবাবুর অনুরোধে সাড়া দিয়েছেন মাত্র। তা ছাড়া, লক্ষ্মণবাবু তো এখনও দলের বাইরে যাননি!
এমন সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে আলিমুদ্দিন বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা তাড়াহুড়ো করার পক্ষপাতী নয়। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর নির্দেশে রাজ্য কমিটির তরফে বিবৃতি দিয়ে এ দিন বলা হয়েছে, ‘রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন জন সদস্য স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জেলা দফতরের সামনে কিছু বহিরাগত ব্যক্তির অবাঞ্ছিত কার্যকলাপের সম্মুখীন হন। এর সঙ্গে পার্টি সদস্যদের কোনও সম্পর্ক থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটিকে বলা হয়েছে।’ জেলা সম্পাদকণ্ডলীর বৈঠকে ওই ঘটনার নিন্দা করে দোষীদের চিহ্নিতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে রাজ্য কমিটি আরও বলেছে, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটতে পারে, তার জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টি নেতৃত্ব, সদস্য ও কর্মীদের সতর্ক থাকতে আহ্বান জানানো হচ্ছে’।
এমতাবস্থায় লক্ষ্মণবাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দল-বিরোধী কাজের মূল অভিযোগ এখন খানিকটা পিছনে চলে গিয়েছে! আলিমুদ্দিন সূত্রের ইঙ্গিত, লোকসভা ভোটের বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে এখনই লক্ষ্মণবাবুকে বহিষ্কার না-করে তাঁকে সাসপেন্ড করা হতে পারে। জেলার লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধেও এখনই কোনও চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অসুবিধা থাকছে। তাই পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখতে গঠন করা হতে তদন্ত কমিশন। আপাতত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব ধামাচাপা দিতে তেমন হলে কমিশন রিপোর্ট দেবে লোকসভা ভোটের পরে। তবে সবই নির্ভর করছে ঘটনাপ্রবাহের উপরে।