লালবাতি বেঁধে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি, কাজ হবে কি না প্রশ্ন

কে লাল, কে নীল— অবশেষে সেটা বেঁধে দিল সরকার। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে গাড়িতে লালবাতির ব্যবহারে রাশ টানতে বৃহস্পতিবার নয়া বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। গত ডিসেম্বরে শীর্ষ আদালত বলে দিয়েছিল, একমাত্র সাংবিধানিক পদাধিকারীরাই গাড়িতে লালবাতি লাগাতে পারবেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০৩:৩৭
Share:

কে লাল, কে নীল— অবশেষে সেটা বেঁধে দিল সরকার।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে গাড়িতে লালবাতির ব্যবহারে রাশ টানতে বৃহস্পতিবার নয়া বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজ্য পরিবহণ দফতর। গত ডিসেম্বরে শীর্ষ আদালত বলে দিয়েছিল, একমাত্র সাংবিধানিক পদাধিকারীরাই গাড়িতে লালবাতি লাগাতে পারবেন। এ বাদে জরুরি পরিষেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি এবং অন্য উচ্চ পদাধিকারীদের কনভয়ে নীল বা মিশ্র রঙের বাতি লাগানো যেতে পারে। তিন মাসের মধ্যে এই নির্দেশ অনুযায়ী বাতি-বিন্যাসের নতুন তালিকা প্রকাশ করতে বলা হয়েছিল কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে। ছ’মাসের মাথায় সেই তালিকা প্রকাশ করল রাজ্য।

নয়া তালিকায় বলা হয়েছে: এখন থেকে শুধু রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতি, বিধানসভার স্পিকার, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বিরোধী দলনেতাই ফ্ল্যাশার-সহ লালবাতি ব্যবহার করতে পারবেন। রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার, কলকাতা পুরসভার মেয়র, রাজ্যের মুখ্যসচিব ফ্ল্যাশার ছাড়া লালবাতি ব্যবহার করতে পারবেন। বাকি যে সব বিশিষ্ট ব্যক্তি বা সরকারি কর্তা এত দিন লালবাতি ব্যবহার করতেন, তাঁরা এ বার থেকে নীলবাতি ব্যবহার করবেন। এই তালিকায় রয়েছেন ভারতরত্ন সম্মানপ্রাপক বা বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যানেরা। রয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি, জেলাশাসক, পুলিশ সুপারের মতো রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাও।

Advertisement

অ্যাম্বুল্যান্স বা দমকলের মতো জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রে কী হবে? নয়া বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক অ্যাম্বুল্যান্সগুলি বেগুনি কাচে ঢাকা ব্লিঙ্কার-সহ লালবাতি ব্যবহার করবে। দমকল, পুলিশ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের গাড়িগুলি লাল, নীল ও সাদা আলো মেশানো আলো ব্যবহার করতে পারবে।

গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জি সিঙ্ঘভি এবং সি নাগাপ্পনের বেঞ্চ বলেছিল, এ দেশে জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে লালবাতি এবং হুটারের যথেচ্ছ অপব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে। এটা গণতন্ত্রের বিরোধী। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, গাড়িতে লালবাতি লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা ইদানীং ক্ষমতা জাহির করার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই কু-রীতিতে আশু লাগাম পরানো প্রয়োজন বলে রায় দিয়েছিল আদালত। সেই নিরিখেই রাজ্যের এই পদক্ষেপ।

সরকারের নির্দেশিকা জারি করতে এত সময় লাগল কেন?

পরিবহণমন্ত্রীর বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বিস্তারিত প্রতিলিপি পাওয়ার পরে অনেক কিছু পরিবর্তন এবং পরিমার্জন করতে হয়েছে। সেটা সময়সাপেক্ষ ছিল। মাঝখানে লোকসভা ভোটও ছিল। এই সব কারণেই দেরি হয়েছে।”

তবে সরকারি নির্দেশিকার পরেও কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কেননা, অতীতেও বিভিন্ন সময় আদালত এই জাতীয় কথা বলেছে। প্রশাসনও ক্ষণিকের জন্য নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। বরং রাজ্য সরকার নানা সময়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে লালবাতি প্রাপকদের তালিকা বাড়িয়েই এসেছে। এ ব্যাপারে বাম জমানা এবং বর্তমান সরকারের মধ্যে কার্যত কোনও তফাৎ নেই। রাজ্য পরিবহণ দফতরের তথ্যই বলছে, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২-র মার্চ পর্যন্ত লালবাতির তালিকায় চার বার সংযোজন হয়েছে। এর পাশাপাশি আইন ভেঙে যথেচ্ছ লালবাতি লাগানোর নজিরও কম নেই।

গত বছর ১৭ মে কলকাতা হাইকোর্ট এই যত্রতত্র আইন-বহির্ভূত ভাবে লালবাতি লাগানো রুখতে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছিল পুলিশকে। গত বছরের অগস্ট মাসে মদনবাবু বলেওছিলেন, “লালবাতি ও হুটার লাগিয়ে অবাধে চলার ক্ষেত্রে কঠোর হবে রাজ্য সরকার। যাঁরা বেআইনি ভাবে লালবাতি ব্যবহার করছেন, তাঁদের অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা ভাবা হচ্ছে।” কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনও অভিযান চোখে পড়েনি।

এ দিন সরকারি নির্দেশিকা জারি করে পরিবহণমন্ত্রী ফের বলেছেন, “সরকারি বিজ্ঞপ্তি কঠোর ভাবে মানা হবে।” কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে তেমন ভরসা দিতে পারছেন না। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানেন, সরকারের বড়-মেজো-ছোট আমলা থেকে পুরসভা-জেলা পরিষদের আধিকারিক পর্যন্ত সকলেই নিজেদের গাড়িতে যথেচ্ছ লালবাতি ব্যবহার করেন। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দেন নানা স্তরের জনপ্রতিনিধিরা। পুলিশের সাধারণ কর্মীরা রাস্তায় এঁদের গাড়ি আটকে ব্যবস্থা নেবেন, এমনটা কষ্টকল্পনা বলেই মনে হয়।

মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, আজ যদি শাসক দলের কোনও শীর্ষনেতা অথবা ডাকসাইটে জনপ্রতিনিধি তাঁর গাড়িতে লাল বা নীলবাতি লাগান, তা হলে পুলিশ কি আইন মেনে ব্যবস্থা নেবে? মদনবাবুর জবাব, “এ ভাবে ‘কেস টু কেস’ বলা সম্ভব নয়।” পরিবহণ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “দফতরের কাজ বিজ্ঞপ্তি জারি করা। সেটা কে মানছেন না, তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের।”

দফতরের কর্তাদেরই ধারণা, নতুন এই বিজ্ঞপ্তির পরে বড়জোর লালের পরিবর্তে নীলবাতির যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হবে। মূল বিষয়, অর্থাৎ ক্ষমতা জাহির করার প্রবণতাটি বদলাবে না। এক কর্তার কটাক্ষ, “এমন নির্দেশিকা-হুঁশিয়ারি আসে যায়। যাঁরা বেআইনি ভাবে বাতি ব্যবহার করেন, তাঁদের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement