লেক মলে মমতা-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীকে সুবিধা কেন, ফাইল তলব সিএজি-র

লেক মল নির্মাণের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পুরসভার কাছে ফাইলপত্র তলব করল সিএজি। বিধি অমান্য করে ৬০ বছরের চুক্তিকে ৩০ বছরের নীচে দু’ভাগে ভেঙে ওই মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২১
Share:

লেক মল নির্মাণের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পুরসভার কাছে ফাইলপত্র তলব করল সিএজি।

Advertisement

বিধি অমান্য করে ৬০ বছরের চুক্তিকে ৩০ বছরের নীচে দু’ভাগে ভেঙে ওই মলের নির্মাণ সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশনকে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে। অভিযোগ, পুরসভার এই বদান্যতায় প্রায় ২৪ কোটি টাকা কম স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হচ্ছে ভেঙ্কটেশকে। অর্থাৎ ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে রাজ্য সরকার। কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল এ বার এ সংক্রান্ত কাগজপত্র খতিয়ে দেখে বুঝতে চাইছে, কেন একটি ব্যবসায়িক সংস্থার খরচ কমাতে বিধি ভাঙল পুরসভা। পুরসভা সূত্রের খবর, ২ জানুয়ারি সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট অফিস থেকে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে পুর প্রশাসনের কাছে। তাতে বলা হয়েছে ওই চুক্তির কাগজপত্র পরখ করে দেখতে চায় তারা। অবিলম্বে তা সিএজি-র রেসিডেন্ট অফিসে পাঠানো হোক।

রাজ্য সরকারের কোষাগারের ক্ষতি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত মোহতার ভেঙ্কটেশকে ওই সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার খবর গত সেপ্টেম্বরে আনন্দবাজারে প্রকাশিত হতেই হইচই শুরু হয়। চুক্তি ভেঙে মোহতার সংস্থাকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে পুরভবনের সামনে সমাবেশ করে বিজেপি। পুরসভার ভেতরে-বাইরে আন্দোলনে নামে কংগ্রেস ও বামেরাও। সরগরম হয়ে ওঠে নবান্নের প্রশাসনিক মহলও। বতর্মানে বিষয়টি এতটাই ‘স্পর্শকাতর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ৪ মাস আগে পুরসভার সঙ্গে হওয়া ওই চুক্তির রেজিস্ট্রেশন পর্ব আটকে রেখেছে সংশ্লিষ্ট দফতরও। নবান্নে অর্থ দফতরের এক অফিসারের কথায়, “খুবই গোপনীয় বিষয়। যা কিছু হচ্ছে একেবারে টপ লেভেলে। কাউকে কিছু জানানো হচ্ছে না!”

Advertisement

নবান্নের একাধিক অফিসার মনে করছেন, এই রাখঢাকের কারণেই বিষয়টি সিএজি-র নজরে পড়েছে। সিএজি সূত্রের খবর, সংবাদপত্রে বিষয়টি প্রকাশ হতেই অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দফতরের একাধিক অফিসার এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার কথা বলেন। তার পরই বিভিন্ন পুরসভায় অডিটের কাজে নিযুক্ত রেসিডেন্ট অডিট দফতর লেক মল সংক্রান্ত ফাইলপত্র মৌখিক ভাবে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন পুরসভার কাছে। পুরসভার এক অফিসার জানান, রেসিডেন্ট অডিট অফিসার (আরএও)-কে সেই সময়ে জানানো হয়, সব কাগজপত্র জোগাড় করে পাঠাতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু মাস কেটে গেলেও তা আর করা হয়নি। এ বার তাই পুরসভার কাছে লিখিত ভাবে লেক মল নির্মাণের চুক্তি সংক্রান্ত ফাইল চেয়ে পাঠালেন সিএজি-র ওই অফিসার। পুরসভা সূত্রের খবর, বর্তমানে ওই ফাইল রয়েছে বাজার দফতরের কাছে। ওই দফতরের স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্টের নামেই চিঠি পাঠিয়েছে সিএজি-র রেসিডেন্ট অডিট শাখা। পুর কমিশনার-সহ পুরসভার অন্য পদস্থ কর্তাদেরও তার অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।

পুরসভার খবর, শনিবারই সিএজি-র চিঠি পুর প্রশাসনের কাছে পৌঁছেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে পুর কমিশনার খলিল আহমেদ-সহ কেউই মুখ খুলতে চাননি। এমনকী লেক মলের ফাইলপত্র রেসিডেন্ট অডিট অফিসে পাঠানো হবে কি না, সেটা-ও বলতে চাননি তাঁরা। যদিও পুরসভার অফিসাররা মনে করেন, রাজস্ব ক্ষতি করে এ ভাবে একটা ব্যবসায়িক সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটা একেবারেই অনৈতিক। সিএজি-র কাছে ফাইল পাঠানো উচিত বলেই মনে করেন তাঁরা। তবে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এমন কোনও চিঠির খবর আমাকে কেউ জানায়নি। সোমবার খোঁজ নিয়ে দেখব।” পুরকর্তারা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর আশপাশে রাজ্যের যে ক’জন ব্যবসায়ীর আনাগোনা, তাঁদেরই এক জন ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা। সে কারণেই ‘উপর মহলের নির্দেশে’ পুর প্রশাসন ভেঙ্কটেশকে বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি কোনও কথা বলতে অস্বীকার করেন।

এর আগে এই ব্যবসায়ীর দফতরেই কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে তল্লাশি চালাতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে রাজ্য অর্থ দফতরের অফিসারদের। তল্লাশিতে নেমে বেশ কিছু ফাইলপত্র আটকও করেছিলেন অফিসাররা। কিন্তু ‘উপরমহল’ থেকে নির্দেশ আসায় সে সব ফাইলপত্র ফেরত দিয়ে চলে আসতে হয়।

পুরসভা কাছ থেকে কী সুবিধা পেয়েছে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন?

নিজেদের হাতে থাকা লেক বাজার ভেঙে মল তৈরির ব্যাপারে ১৯৮৭ সালে অরুণ প্লাস্টিক প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছিল পুরসভা। পুর নথি অনুসারে, সে চুক্তির মেয়াদ ছিল ৬০ বছর। কিন্তু পরে সেই অরুণ প্লাস্টিকই নাম বদলে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন হওয়ায় পুরনো মডেল লিজ চুক্তির সূত্র ধরেই ২০১০ সালে তাঁদের সঙ্গে ফের চুক্তি করে পুরসভা। ৬০ বছরের সেই চুক্তিকে ৩০ বছরের নীচে দু’ভাগে ভেঙে দেওয়ার আবেদন জানায় ভেঙ্কটেশ সংস্থা। গত সেপ্টেম্বরে মেয়র পারিষদের বৈঠকে ভেঙ্কটেশের সেই আবেদন অনুমোদন করা হয়।

কেন এই চুক্তির মেয়াদ কমানো?

সরকারি আইন অনুযায়ী, লিজ চুক্তি ৩০ বছরের বেশি হলে তা রেজিস্ট্রেশন করাতে সম্পত্তির বাজার দর ধরে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। কিন্তু চুক্তিটি ৩০ বছর বা তার কম হলে রেজিস্ট্রেশন হয় গড় লিজ ভাড়ার (অ্যাভারেজ লিজ রেন্ট) ভিত্তিতে। এই হিসেবে লিজ চুক্তির মেয়াদ ৬০ বছর থাকলে ভেঙ্কটেশকে স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ দিতে হতো প্রায় ২৪ কোটি টাকা। কিন্তু চুক্তিটি দু’ভাগে ভেঙে দেওয়ায় তাদের স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হচ্ছে মাত্র ৭ লক্ষ টাকা। সিএজি চিঠিতে বলেছে, বিধিভঙ্গ করে ভেঙ্কটেশের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ কেন কমানো হল, সেটাই তারা যাচাই করে দেখতে চায়।

পুরসভা সূত্রের খবর, লেক মলে মোট জায়গার পরিমাণ ১৯ হাজার ৯২৫ বর্গ মিটার। লিজ চুক্তি অনুযায়ী পুরনো বাজারের সব দোকানদারকে পুনর্বাসন দিতে এক তলায় ৩২৯৮ বর্গ মিটার জায়গা লেগেছে। ৬ এবং ৭ তলায় পুরসভাকে দিতে হয়েছে এক হাজার বর্গমিটার। বাকি থাকে ১৫,৬২৭ বর্গ মিটার বা ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৪০ বর্গফুট। চুক্তি অনুযায়ী ওই জমি ভাড়া দিতে পারবে ভেঙ্কটেশ ফাউন্ডেশন।

রাজ্য সরকারের স্ট্যাম্প ডিউটি আইন অনুযায়ী ৩০ বছরের বেশি লিজ চুক্তি হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাজার দরের উপর ৭ শতাংশ হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। লেক মল এলাকার বাণিজ্যিক নির্মাণের বর্তমান বাজার দর বর্গফুট পিছু ২০ হাজার টাকারও বেশি। সেই হিসেবে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৪০ বর্গফুটের জন্য বাজার দর হচ্ছে প্রায় ৩৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশনের জন্য মোট বাজার দরের ৭ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো ভেঙ্কটেশকে। যার পরিমাণ প্রায় ২৪ কোটি টাকা।

কিন্তু ৩০ বছর বা তার কম সময়ের জন্য লিজ চুক্তি রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে লিজ ভাড়ার ভিত্তিতে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয় বলে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা ভেঙ্কটেশকে দিতে হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে পুরসভার চুক্তি অনুযায়ী লিজ ভাড়া প্রতি বর্গফুটে ১ টাকা ৬৩ পয়সা। ফলে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হচ্ছে মাত্র ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার ৯০১ টাকা।

পুরসভা সূত্রের খবর, আলিপুর জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে ওই চুক্তিটি জমা পড়ে রয়েছে। লিজ ভাড়া অনুযায়ী স্ট্যাম্প ডিউটি রেজিস্ট্রেশন দফতরে জমাও দিয়ে দিয়েছে ভেঙ্কটেশ। কিন্তু তার পরেও রেজিস্ট্রেশন হয়নি। সিএজি এখন লেক মলের ফাইলপত্র চেয়ে পাঠানোয় কেউই আর রেজিষ্ট্রেশন দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইবে না বলে ধারণা নবান্নের একাধিক অফিসারের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement