অধিগ্রহণ অচ্ছুৎ। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলে দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়তে হলে বেসরকারি সংস্থাকে সরাসরি মালিকদের থেকে জমি কিনে নিতে হবে। এ বার রাস্তা-সেতু-নিকাশির মতো পরিকাঠামো তৈরির জন্য চাষিদের থেকে সরাসরি জমি কেনার নির্দেশ জারি হল তাঁর সরকারের সব দফতরের উদ্দেশেও। এ ক্ষেত্রেও অধিগ্রহণের পথে হাঁটতে তাঁর সরকার নারাজ।
মমতা সরকারের এ হেন ফরমান শুনে শিল্পমহলের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের বড়-মাঝারি-ছোট মন্ত্রীরা গত সাড়ে তিন বছর ধরে যে ‘জমি ব্যাঙ্কের’ ঢাক পিটিয়ে চলেছেন, তার কী হল? ব্যাঙ্কের জমি কি কোনও কাজে লাগবে না?
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য এমনটি মনে করে না। তাদের বক্তব্য: সব ক্ষেত্রে যে ব্যাঙ্কের জমি কাজে আসবে না, সেটা স্বাভাবিক। উদাহরণও দেওয়া হচ্ছে ধরা যাক, স্কুলবাড়ির জন্য কোনও জেলা শহর বা ব্লকে নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ ব্যাঙ্কে চিহ্নিত জায়গার জমি নেই। তখন শহর বা ব্লকের যে জমি ব্যাঙ্কে রয়েছে, সেখানে স্কুলবাড়িটি বানানো যেতে পারে। একই ভাবে জমি ব্যাঙ্কের জমিতে কলেজ, পুলিশ ফাঁড়ি, পাম্পিং স্টেশন হতে পারে। “কিন্তু যে সব কাজের জন্য (বিশেষত রাস্তা-সেতু-কালভার্ট-নিকাশি নালা ইত্যাদির মতো পরিকাঠামো নির্মাণ) নির্দিষ্ট জায়গাই দরকার, সেখানকার জমি ব্যাঙ্কে না-থাকলে? তখন তো আর বিকল্প জায়গা খুঁজলে চলবে না!” বলছেন নবান্নের এক কর্তা।
এমন পরিস্থিতিতে যে সামান্য জমি দরকার, দফতরগুলোকে সেটাই সরাসরি চাষিদের থেকে তা কিনে নিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বস্তুত এই যুক্তিকে হাতিয়ার করেই সরকারের নয়া নির্দেশিকা। তার বক্তব্য, জমির সঙ্কটে কয়েকশো সরকারি প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। স্রেফ ছোট ছোট জমির অভাবে রাস্তা-সেতু-কালভার্টের মতো জরুরি পরিকাঠামো আটকে থাকছে। সরকারি আধিকারিকদের একাংশের আক্ষেপ, শিলান্যাসের তালিকা দীর্ঘ হলেও জমির জটে ফেঁসে বহু প্রকল্প দিনের আলো দেখতে পারছে না। মমতার ঘনিষ্ঠ মহলের এক সূত্রের কথায়, “জরুরি পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে সামান্য জমির বাধায় অনেক সময় সব কিছু থমকে যাচ্ছে। এই সমস্যারই সুরাহার চেষ্টা হয়েছে।”
নির্দেশিকায় আর কী রয়েছে?
নবান্নের খবর, এত দিন কোনও প্রকল্পে জমি দরকার হলে সংশ্লিষ্ট দফতরকে ভূমি দফতরের দ্বারস্থ হতে হতো। এ বার প্রথমে সরকারের শিল্প, পরিকাঠামো ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটিকে বিস্তারিত জানিয়ে জমি কেনার আবেদন করতে হবে। কমিটির মাথায় রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তারা অনুমোদন দিলে প্রকল্পের বিস্তারিত জানিয়ে সরকারি দফতর ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে নোটিস দিতে হবে। তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট জমির ইচ্ছুক মালিকেরা জমি বিক্রি করতে চেয়ে আবেদন করবেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার জমির দাম ঠিক করবে। কী ভাবে?
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, জমির বাজারদর মেনেই দাম স্থির হবে। অথবা আলোচনার মাধ্যমে যা ঠিক হবে, সেই দামে জমি কিনবে দফতর। জমির দর নির্ধারণে একটি ‘পারচেজ কমিটি’ও গঠিত হয়েছে, যাতে থাকবেন ভূমি দফতরের আধিকারিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। জমি বিক্রিকে উৎসাহ দিতে ‘বিশেষ অনুদান’ও ঘোষিত হয়েছে। যিনি যত দ্রুত জমি বেচবেন, তিনি তত বেশি অনুদান পাবেন।
নতুন নির্দেশিকা প্রসঙ্গে সরাসরি মুখ খুলতে না-চাইলেও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা এ নিয়ে রীতিমতো বিভ্রান্ত। তাঁদের বক্তব্য, বহু চেষ্টায় একটি জমি ব্যাঙ্ক (সরকারি তথ্য মোতাবেক যেখানে বিভিন্ন দফতরের প্রায় ৬০ হাজার একর জমি মজুত) তৈরি হলেও তা যে বড় শিল্পের কাজে লাগবে না, প্রথম দিনই তা বোঝা গিয়েছিল। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীও সেটা বুঝেছিলেন বলেই বরাবর তাঁরা বিনিয়োগকারীদের জমি কিনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন। এ বার পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য দফতরগুলোকেও জমি কিনতে বলা হল। “বছরে ক’টা স্কুল-কলেজ-থানা বা ওই ধরনের নির্মাণ হয়? বরং নিত্য দিনের কাজে গ্রাম-শহরে রাস্তা-সেতু-নিকাশির মতো জরুরি পরিষেবা গড়তেই তো জমি লাগে। সে সব কাজে ব্যাঙ্কের জমি পাওয়া না-গেলে জমি ব্যাঙ্ক রেখে লাভ কী?” প্রশ্ন এক আধিকারিকের।
এমতাবস্থায় জমি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জমি দফতরগুলোর হাতে ফিরিয়ে দেওয়াই শ্রেয় বলে ওঁরা মনে করছেন। কিন্তু আগে যেখানে সরকারি কাজের প্রয়োজন মেটাতে জমি অধিগ্রহণ করা হতো, এখন তার পরিবর্তে কিনে নেওয়ার নির্দেশ কেন?
নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: অধিগ্রহণের পদ্ধতি মেনে জমি হেফাজতে নিতে কম-বেশি তিন বছর লেগে যায়। এখন শুরু করলে জমি হাতে পেতে পেতে ২০১৭ সাল হয়ে যাবে। ২০১৬-য় রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে কিছু কাজ করে দেখানোর তাগিদ রয়েছে।
অতএব, তড়িঘড়ি জমি কিনে সরকার ভোটের আগে পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করতে চাইছে বলে জানিয়েছে এই মহল।