খিদিরপুরের ঘটনাকে গণধর্ষণের মামলা হিসেবেই আদালতে পেশ করল পুলিশ।
ধৃত মহম্মদ হামিদ ওরফে রাজকে মঙ্গলবার আলিপুর মুখ্যবিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করানো হয়। রাজের হয়ে আলিপুর আদালতের কোনও আইনজীবী দাঁড়াতে চাননি। শেষে লিগ্যাল এড-এর পক্ষ থেকে বিকাশ গুছাইত নামে এক আইনজীবীকে দাঁড় করানো হয়। সরকার পক্ষের আইনজীবী সৌরীন ঘোষাল আদালতকে জানান, রাজ এবং তার চার সঙ্গী মিলে রবিবার রাতে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেছে। রাজ ধরা পড়লেও বাকিরা ফেরার। তাদের সম্পর্কে তথ্য পেতে রাজকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চায় পুলিশ। সেই আর্জি মেনে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক সঞ্জীব দারুকা।
সোমবার রাতে রাজকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি ওয়াটগঞ্জের আজাদ ময়দানকে ঘটনাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ওই জায়গা থেকে আটক করা হয়েছে একটি ষোলো চাকার লরি। ওই লরির ভিতরেই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রের খবর, লরির কেবিন থেকে একটি কম্বল ও একটি সাদা রঙের টি-শার্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। লরিটির আসল মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।
সোমবার রাতে রাজকে দফায় দফায় জেরা করা হয়। পুলিশের দাবি, জেরায় নিজের দোষ কবুল করলেও গণধর্ষণে আর কে কে ছিল, তা নিয়ে মুখ খোলেনি সে। এ নিয়ে আজাদ ময়দানের নিরাপত্তারক্ষীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আটক করা লরিটি দিন কয়েক আগে রং করার জন্য আজাদ ময়দানে আনা হয়েছিল। সেই সময় রাজ রঙের মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজও করেছিল।
পুলিশ জানিয়েছে, নির্যাতিতা তরুণী সেই রাতে যে পোশাক পরেছিলেন, তা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। রাজের জামাকাপড়ের ফরেন্সিক পরীক্ষা ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতে আর্জি জানান সরকার পক্ষের আইনজীবী। তিনি আদালতে জানান, নির্যাতিতা তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। তাঁর আরও কিছু পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। কিন্তু তরুণীর শারীরিক অবস্থা ভাল না হওয়ার জন্য সেগুলি এখনও করানো যায়নি।
ওয়াটগঞ্জের আজাদ ময়দান, যেখানে ধর্ষণ হয়েছিল।
তদন্তকারীদের দাবি, রবিবার রাতে ওই তরুণীকে নিয়ে খিদিরপুরের কার্ল মার্ক্স সরণির একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন রাজ। সেই রেস্তোরাঁর সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছে, দু’জনে নরম পানীয় খাচ্ছেন। পুলিশের দাবি, ওই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে তরুণীকে নিয়ে ওই এলাকারই আর একটি রেস্তোরাঁয় যায় রাজ। সেখানে তারা রাতের খাবার খায়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, খাবার বাবদ প্রায় ২০০ টাকা বিলও মেটায় রাজ।
এর পাশাপাশি তরুণীর মোবাইল ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ওই সময়ে তিনি তাঁর এক সহকর্মীকে তিন বার ফোন করেছিলেন। ওই সহকর্মীকে জেরা করে পুলিশের ধন্দ আরও বেড়েছে। ওই সহকর্মী তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, তরুণী তাঁকে বলেন, তিনি খিদিরপুরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাওড়া যাওয়ার জন্য কোনও গাড়ি পাচ্ছেন না। তরুণী কেন এমন কথা বললেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
পুলিশের দাবি, রাজ বলেছে, রাতের খাবার শেষ করে ওই তরুণীকে নিয়ে সে সুধীর বসু রোডে এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল। সেখানে তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়নি। এর পরেই আজাদ ময়দানের কাছে চলে আসে তারা।
এই ট্রাকেই ধর্ষিত হন তরুণী।
খিদিরপুর এলাকায় একটি সিসিটিভি ফুটেজে দু’জনের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য ধরা পড়েছে বলে পুলিশের দাবি। তদন্তকারীদের দাবি, রাত একটার পর এলাকা ফাঁকা হওয়ায় সে ওই তরুণীকে নিয়ে ময়দানের ভিতরে যায় বলে রাজ জানিয়েছে। লরির ভিতরে সে একাই মেয়েটিকে তিন বার ধর্ষণ করে বলে জানিয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ওই তরুণীর সঙ্গে যৌন সংসর্গের আগে রাজ মাদক নিয়েছিল। তার আগে মদ্যপানও করেছিল বলে রাজ পুলিশের কাছে কবুল করেছে। কিন্তু তরুণী নিজে বারবারই বলে আসছেন, তাঁর উপরে অনেকে মিলে অত্যাচার করেছে। অথচ রাজ তা বলছে না। বয়ানের এই ফারাক কেন, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “তরুণী বলেছেন, তাঁর উপর পাঁচ-ছ’জন মিলে অত্যাচার চালিয়েছে। তবে ধৃত হামিদ ওরফে রাজ আমাদের বারবার বলছে, রবিবার রাতে শুধু তার সঙ্গেই ওই তরুণীর যৌন সংসর্গ হয়েছিল, ঘটনাস্থলে আর কেউ ছিল না। বয়ানের মধ্যে এই পার্থক্য কেন, এর পিছনে কোনও অভিসন্ধি আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখছি। আমরা কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি।”
পুলিশ এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য দু’রকম সম্ভাবনাই উঠে আসছে। একটা বিষয়ে সকলেই একমত কোনও মহিলার সঙ্গে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গম করা হলে তাঁর শরীরে যথেষ্ট হরমোন নিঃসরণ ঘটে না। তার মধ্যে উপর্যুপরি ‘পেনিট্রেশন’ হলে তবেই যোনি ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই ক্ষেত্রে একাংশের মত, যে ভাবে মেয়েটির যোনি ছিন্নভিন্ন হয়েছে, তাতে ধর্ষণের সময় একাধিক পুরুষ উপস্থিত না থাকাটাই অস্বাভাবিক।
মেয়েরা শুনুন
মহিলা হেল্পলাইন নম্বর কলকাতা পুলিশ এলাকায় ১০৯১, ১০৯০
রাজ্যের সর্বত্র ১০০
• যেখানেই যান, সঙ্গে থাক পুলিশের হেল্পলাইন নম্বর
• যাতায়াতের পথে থানা/কিয়স্ক খেয়াল রাখুন
• বিপদে পুলিশের সাহায্য নিতে দ্বিধা নয়
• মনে রাখুন, রক্ষী-সহ এটিএম কোথায় আছে
• বেগতিক বুঝলে সেই এটিএমে ঢুকে পড়ুন
• শেয়ার বা শাট্ল ট্যাক্সি/গাড়ি এড়িয়ে চলুন
• ট্যাক্সি বা শাট্ল গাড়ির নম্বর দেখে উঠুন
• উঠেই পরিজনকে নম্বর এসএমএস করুন
• শারীরিক ভাবে যতটা সম্ভব ফিট থাকুন
• বডি স্প্রে, চুলের কাঁটা কাজে আসতে পারে
কারণ এক জন পুরুষ সঙ্গম প্রক্রিয়ায় যতই সক্রিয় ভূমিকা নিক না কেন, তারও সীমাবদ্ধতা থাকে। কত বার সে শারীরিক মিলনে সক্ষম এবং তার হিংস্রতার মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আর একটি মত রাজ যেহেতু মাদক নিয়েছিল ও মদ্যপান করেছিল, এই দুয়ের প্রভাবে তার হিংস্রতা এবং শারীরিক শক্তি বেড়ে গিয়ে থাকতে পারে। উপর্যুপরি বলপ্রয়োগে মেয়েটির অতখানি ক্ষত হওয়া অসম্ভব নাও হতে পারে। তা ছাড়াও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রথম বার সঙ্গমের পরে বহু ক্ষেত্রে মহিলাদের রক্তপাত হয়। তার পরেও একাধিক বার ‘পেনিট্রেশন’ হলে রক্তপাতের পরিমাণ এমনই বেড়ে যায় যে, সংশ্লিষ্ট মহিলা নেতিয়ে পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে সে রকম হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
রাজ পুলিশকে জানিয়েছে, ধর্ষণের পরে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে, সে নিজেই ট্যাক্সি করে তাঁকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেয়। তার পর ফিরে আসে খিদিরপুরে। গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানেই ছিল সে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, হাওড়া স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে রাজের কথার সমর্থন মিলেছে। ওই ফুটেজে তরুণীকে রাজের সঙ্গেই দেখা গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। রাজ জেরায় দাবি করেছে, নির্যাতিতা তরুণী যে শপিং মলে কাজ করতেন, সেখানে হামিদের এক তুতো দিদিও কর্মরত। মাঝেমধ্যে ওই দিদিকে সেখান থেকে আনতে যেত রাজ। সেই সূত্রেই দু’সপ্তাহ আগে তার সঙ্গে ওই তরুণীর আলাপ হয়। রাজ বলেছে, রবিবার রাতে খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটের সামনে তবে গোয়েন্দা সূত্রের খবর, রাজ এলাকায় ছিনতাইবাজ হিসেবে পরিচিত। গত জুন মাসে বন্দর পুলিশের বিশেষ দলের (এসএসপিডি) হাতে ধরা পড়ে সে। আগেও ধরা পড়ার রেকর্ড আছে। এক গোয়েন্দা-কর্তা বলছেন, “এই কারণেই রাজের বক্তব্য পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তরুণীর বয়ান না পেলে ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।” তরুণীর শারীরিক অবস্থা এখনও ভাল নয়। তাই তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিচারকের কাছে ওই তরুণী গোপন জবানবন্দি দিলে, অনেক ধন্দ কেটে যাবে বলেই পুলিশের আশা।