রাজ্যে রোহিঙ্গা কয়েদির বহর দেখে চিন্তায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক

বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে এমনিতেই মাথাব্যথার অন্ত নেই। তার সঙ্গে জুড়ল মায়ানমারের রোহিঙ্গা। গত দু’বছরে পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিম বন্দির সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়েছে। যে তথ্য হাতে পেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কপালে উদ্বেগের ভাঁজ। মন্ত্রকের কর্তাদের আশঙ্কা, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। “শুধু জেলেই প্রায় শ’খানেক বন্দি!

Advertisement

অত্রি মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৪
Share:

বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে এমনিতেই মাথাব্যথার অন্ত নেই। তার সঙ্গে জুড়ল মায়ানমারের রোহিঙ্গা।

Advertisement

গত দু’বছরে পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিম বন্দির সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়েছে। যে তথ্য হাতে পেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কপালে উদ্বেগের ভাঁজ। মন্ত্রকের কর্তাদের আশঙ্কা, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। “শুধু জেলেই প্রায় শ’খানেক বন্দি! ধরে নেওয়া যেতেই পারে, অবৈধ ভাবে সীমান্ত টপকে আরও বহু রোহিঙ্গা এ দেশে চলে এসেছেন!” বলছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক অফিসার।

এ হেন পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তায় নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে বলে দিল্লি মনে করছে। বস্তুত বাংলাদেশি তো বটেই, চাকমা, রিয়াং থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কার তামিল এ দেশের মাটিতে নানা দেশের নানা জাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বিধি বহির্ভুত আগমন নিয়ে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়েছে ভারতকে। এবং সমস্যা এখনও পুরো কাটেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের খবর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চাকমা ও রিয়াং শরণার্থীদের কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া সামাজিক অস্থিরতা সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি। তামিলনাড়ুতেও এক অবস্থা। দক্ষিণ শ্রীলঙ্কা থেকে উৎখাত হয়ে আসা তামিলদের নিয়ে সেখানে প্রাশাসনকে হামেশায় ভুগতে হচ্ছে।

Advertisement

এমতাবস্থায় ভারতের মাটিতে মায়ানমারি রোহিঙ্গাদের ঢল নামার ইঙ্গিতের মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছে দিল্লি। এঁরা কারা?

রোহিঙ্গা জনজাতির মুসলিম সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলি আদতে মায়ানমারের রাখিন প্রদেশের বাসিন্দা। বেশ ক’বছর আগে স্থানীয় দুই সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের জেরে তাঁরা ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশে ঢুকে চট্টগ্রাম, বান্দারবান, রাঙামাটি ও কক্সবাজারের নানা জায়গায় আস্তানা গাড়েন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের এক দিকে চট্টগ্রাম, অন্য দিকে রাখিন প্রদেশ। কার্যত গা ঘেঁষাঘেঁষি। এই আঞ্চলিক নৈকট্যের সুবাদে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের সামাজিক জীবনযাপনেও বিস্তর মিল।

২০১২ সালে রাখিন প্রদেশে ফের স্থানীয় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল হানাহানি বাঁধে। যার জেরে চট্টগ্রামের দিকে নতুন করে শরণার্থী-স্রোত শুরু হয়। কিন্তু এই দফায় বাংলাদেশের সীমান্ত পেরোনো সহজ হয়নি। নয়াদিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের খবর, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে ওখানকার সীমান্তরক্ষীরা রোহিঙ্গা দেখলেই ফেরত পাঠানোর (পুশব্যাক) সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের উপরেও শুরু হয়েছে নজরদারি।

আর দুইয়ে মিলে শরণার্থী-স্রোতের অভিমুখ ভারতের দিকে ঘুরে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, যাঁরা বাংলাদেশ সীমান্তে এসে ঠোক্কর খাচ্ছেন, তাঁদের অনেকে ঘুরপথে মিজোরাম-অরুণাচল দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কড়া প্রহরা সত্ত্বেও কিছু রোহিঙ্গা এখনও নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকছেন। তার পরে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের দলে মিশে ভারতে চলে আসছেন। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ডেরা বাঁধা রোহিঙ্গাদের বড় অংশও স্থানীয় প্রশাসনিক প্রতিকূলতার মুখে পড়ে একই পথ ধরছেন।

পরিণামে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে বলেই দিল্লির ধারণা। ওঁদের পরিচিতি নিয়ে ধন্দের ফলে সমস্যা জটিল হয়েছে। এ রাজ্যের কারা দফতরের এক কর্তার কথায়, “চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে ওঁদের আচার-আচরণে মিল থাকায় বিএসএফ অনেক সময়েই ধরে নেয়, ধৃত ব্যক্তি বাংলাদেশি। জেলে আনার পরে মালুম হয়, ওঁরা আসলে রোহিঙ্গা! মায়ানমারের লোক!”

রাজ্য কারা-সূত্রের খবর, বালুরঘাট আর বহরমপুরের জেলে এ ধরনের রোহিঙ্গা কয়েদির সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলোয় বন্দি মোট বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত সাড়ে তিন হাজার। কয়েদির অত্যধিক চাপ সামাল দিতে গিয়ে জেল-কর্তারা হিমশিম। উপরন্তু কারাবাসের মেয়াদ ফুরোলেও বাংলাদেশি বন্দিদের অনেককে দেশে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা বন্দির বহর বাড়তে থাকায় কারা-কর্তারা যারপরনাই চিন্তিত। তাঁদের দাবি, দেড় বছরে পশ্চিমবঙ্গে বন্দি রোহিঙ্গার সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। “রোহিঙ্গা বন্দি ক্রমশ বাড়ছে। ব্যাপারটা আমরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়েছি।” বলেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (কারা) অধীর শর্মা। মোকাবিলার কোনও উপায় নেই?

কারা দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এ রাজ্যে ঢুকতে গিয়ে যাঁরা বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছেন, তাঁরা জেলে রয়েছেন। তাঁদের ফেরানোর একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যে রাজ্যে ঢুকে জনারণ্যে মিশে গিয়েছেন?

আসল চিন্তাটা তাঁদের নিয়েই। কারণ বোধগয়া বিস্ফোরণে রোহিঙ্গা-যোগের অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দামহলের আশঙ্কা, সন্ত্রাসবাদীরা এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভুল বুঝিয়ে নাশকতার কাজে লাগালে সেটা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement