• লালগড়ের ধরমপুর আর হরিনা গ্রামে মাওবাদী পোস্টার পড়ার খবর পেয়ে সাতসকালে ছুটেছিল যৌথ বাহিনী। অফিসারদের অধিকাংশই নিশ্চিত ছিলেন, মাওবাদীরা আসন্ন লোকসভা ভোট বয়কটের ডাক দিয়ে পোস্টার সেঁটেছে। গত সপ্তাহের ঘটনা। প্রচার তখন শুরু হয়ে গিয়েছে জোরকদমে। বয়কটের ডাক দেওয়ার তো এটাই আদর্শ সময়, ভেবেছিলেন ওই অফিসারেরা। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, কোনও পোস্টারেই ভোট বয়কটের কথা নেই। তবে তৃণমূল ও রাজ্য সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে আক্রমণ করা হয়েছে।
• দিন পাঁচেক আগে ওড়িশার রায়গড় জেলার কল্যাণসিংহপুর ব্লকের কয়েকটি গ্রাম থেকে যৌথ বাহিনী উদ্ধার করেছে বেশ কিছু মাওবাদী পোস্টার। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় মাওবাদীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, গ্রামের মানুষ যেন ভোটদান থেকে বিরত থাকেন। ভোটাধিকার প্রয়োগের বদলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জল, জঙ্গল ও জমির অধিকার অর্জনের উপর জোর দিতে বলেছে মাওবাদীরা। শুধু রায়গড় জেলাই নয়, ওড়িশার মালকানগিরি ও কোরাপুট জেলাতেও আসন্ন লোকসভা নির্বাচন বয়কট করতে হবে বলে জানিয়ে মাওবাদীরা গ্রামে গ্রামে পোস্টার সেঁটেছে।
ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য। অথচ মাওবাদীরা ওড়িশায় ভোট বয়কটের ডাক দিলেও পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে এখনও সেই পথে হাঁটেনি। মাওবাদীদের পূর্বাঞ্চল ব্যুরোর অধীনে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা ছাড়াও রয়েছে বিহার ও ঝাড়খণ্ড। ওড়িশার পাশাপাশি ঝাড়খণ্ড, বিহারেও লোকসভা ভোট বয়কট করার ডাক দিয়ে মাওবাদী প্রচার শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, মাওবাদীদের পূর্বাঞ্চল ব্যুরো একটি ‘চুনাও বহিষ্কার ঘোষণাপত্র’ বা ভোট বর্জনের ঘোষণাপত্রও তৈরি করেছে। ওই ঘোষণাপত্র ওড়িশা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে শীঘ্রই ছড়ানো হবে বলে মাওবাদী নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিলেও পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা এখনই সে রকম কিছু করার কথা ভাবছেন না।
কিন্তু ভোট বয়কটের ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলের বাকি তিনটি রাজ্যে মাওবাদীদের এক রকম নীতি আর পশ্চিমবঙ্গে অন্য রকম নীতি কেন? কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র এক কর্তার বক্তব্য, “ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া হবে আর সাধারণ মানুষ ভয়ে কিংবা মন থেকে সেটা মেনে নেবেন, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের আর সেই প্রভাব নেই। তাই, সেখানে ভোট বয়কটের ডাক দিতে চায় না তারা।”
তবে রাজ্য গোয়েন্দা শাখার এক অফিসার জানান, মাওবাদী নেতৃত্বের একাংশ এ বার পশ্চিমবঙ্গে ভোট বয়কটের পথে হাঁটতে চাইছেন না এবং এর পিছনে কৌশলগত কারণ আছে। তাঁর যুক্তি, সাধারণ ভাবে ভোট বয়কটের ডাকে মন থেকে যাঁরা সাড়া দেন, তাঁরা শাসকদলের বিরোধী। কাজেই, মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকে যাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকবেন, তাঁরা আখেরে শাসকদলেরই সুবিধে করে দেবেন। অথচ জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের প্রধান শত্রু এখন তৃণমূল। ওই অফিসারের বক্তব্য, “ভোটে তৃণমূলের সুবিধে হবে, এমন কিছু মাওবাদীরা করতে চাইছে না।” এমনকী, মাওবাদীদের কয়েকটি গণ সংগঠন শহর ও শহরাঞ্চলে ‘না ভোট’-এর পক্ষে প্রচার শুরু করলেও মাওবাদী নেতৃত্বের একাংশ জঙ্গলমহলে এমনটা করতে রাজি নন।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের পয়লা নম্বর শত্রু ছিল সিপিএম। জঙ্গলমহলে সে বার ভোট গ্রহণের দিন ছিল ৩০ এপ্রিল। নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, টানাপড়েনের পর মাত্র দু’দিন আগে, ২৮ এপ্রিল ভোট বয়কটের প্রচার পুরোদমে শুরু করে মাওবাদীরা। জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ সে বার ভোট দেননি।
আবার ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি ঘোষণা করেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। এই নিয়ে মাওবাদী নেতৃত্বের অভ্যন্তরে মতবিরোধ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত পার্টি কিন্তু ভোট বয়কটের প্রচার করেনি।
আইবি-র এক শীর্ষকর্তার কথায়, “২০১১-র রাস্তাতেই মাওবাদীরা এ বার হাঁটবে বলে এখনও আমাদের মনে হচ্ছে। তবে এ বার ওদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।”