ছিন্ন, মলিন বসনও শ্রেয়। কিন্তু দান গ্রহণে ঘোর অপারগ মাহুলিটাঁড়। বিশেষ করে সে দান যদি আসে তৃণমূল বা সরকারের তরফে।
পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন কালীপুজোর দিন।
বাকি সব ক’টা গ্রামের দুঃস্থ মহিলারা জনে জনে এসে শাড়ি নিয়ে গেলেন। কিন্তু মাহুলিটাঁড় গ্রামের এক জনেরও দেখা নেই! বস্ত্র বিতরণের সময়সীমা ছিল বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে চারটে। সেই সময় পেরিয়ে সন্ধে ছ’টা গড়াল।
বলরামপুরের করমা কালীমন্দিরে বস্ত্র বিতরণ করছিলেন সৃষ্টিধর। ঘাটবেড়া, কলাবেড়া, করমা, মাহুলিটাঁড়ের মতো অভাবী কয়েকটি গ্রামের হতদরিদ্র মহিলাদের ডাকা হয়েছিল সৃষ্টিধরের হাত থেকে কাপড় নিয়ে যেতে। প্রত্যেকের জন্য শ’তিনেক টাকার ছাপা শাড়ি একটি করে। দারিদ্র্যে জর্জর মহিলাদের কাছে ওটুকুই অনেক। আর ওই সব গ্রামের মধ্যে দারিদ্র্যের নিরিখে প্রথমেই উঠে আসে মাহুলিটাঁড়। লজ্জা নিবারণে এক টুকরো ন্যাতানো কাপড় জোগাড় করাই বড় সমস্যা ওই গ্রামের অনেক মহিলার কাছে।
করমা কালীমন্দির থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়তলির ওই গ্রামে ৫৮টি পরিবারের বাস। গুটি কতক মাহাতো, বাকি সব আদিবাসী। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব গ্রামের ৩২টি পরিবারকে অতি দুঃস্থ হিসেবে চিহ্নিত করে মহিলাদের শাড়ি নিতে যেতে বলেছিলেন। ঘাটবেড়া-কেরুয়ায় শাসক দলের অঞ্চল সভাপতি সন্তোষ মাহাতোর আক্ষেপ, “মাহুলিটাঁড়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলেও এক জন এল না! অথচ আট কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা পাহাড়ের উপর প্রত্যন্ত কলাবেড়া গ্রাম থেকেও মহিলারা উজিয়ে এসেছেন।”
ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য মাহুলিটাঁড়ে ঢুকতেই কুঁড়েঘরের দেওয়ালে মাটি লেপায় ব্যস্ত কয়েক জন মহিলা কড়া চোখে জানিয়ে দিলেন, “কথা বলার মতো কেউ নাই।” গ্রামের উত্তর দিক বরাবর কিলোমিটার দুয়েক গেলেই শুরু হচ্ছে অযোধ্যা পাহাড়। গোটা গ্রাম জুড়ে দারিদ্র্যের চিহ্ন প্রকট। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, গ্রাম তখন পুরুষশূন্য। মিনিট সাতেক অপেক্ষা করার পরে এক জন-দু’জন করে পুরুষ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরোতে লাগলেন। সাংবাদিক পরিচয় জানার পরেও সকলের দৃষ্টিতে সন্দেহ। কাপড় নিতে না যাওয়ার বিষয়ে এক এক জনের বক্তব্য এক এক রকম। ত্রিলোচন মাহাতো, মঞ্জু মাহাতোদের দাবি, “আমরা তো কাপড় দেওয়ার কথা জানতামই না।” আ বার গোপাল সরেন, গাঁতে সরেনদের বক্তব্য, “কাপড় দেওয়ার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু কবে দেবে তা জানতাম না।”
সন্তোষ মাহাতোর বক্তব্য, “ডাহা মিথ্যে। আসলে মগজধোলাই হয়েছে। মাওবাদীদের বুদ্ধিতেই ওরা শাড়ি নিতে আসেনি।” তৃণমূল তো বটেই, গোয়েন্দাদের একাংশেরও মতে, বুদ্ধির জোগান আসছে অযোধ্যা পাহাড় থেকে। তাঁদের বক্তব্য, লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের নিমডি থানা এলাকার টেঙাডি গ্রামের বীরেন সিংহ সর্দার ওরফে সাগরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি স্কোয়াডের নিয়মিত গতিবিধি রয়েছে ঘাটবেড়া-কেরুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অন্তর্গত অযোধ্যার পাহাড়ে-জঙ্গলে। গোয়েন্দা-তথ্য অনুযায়ী, ওই স্কোয়াডে মহিলা দু’জন। এবং তাঁদের এক জন বাঁধডি গ্রাম ও অন্য জন এই মাহুলিটাঁড়েরই বাসিন্দা।
স্থানীয় সূত্রের খবর, সভাধিপতি কাপড় দেবেন এই খবর চাউর হওয়ার পর মাওবাদীরা জানায়, কিছুতেই ওই দান গ্রহণ করা চলবে না। স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয় মাহুলিটাঁড়। গোয়েন্দারা জেনেছেন, খাবার ও অন্যান্য রসদের প্রয়োজনে অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে মাওবাদীরা মাহুলিটাঁড়ের মতো গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে এখনও আশ্রয় পাচ্ছে। আর মাহুলিটাঁড়ের মেজাজ বলে দিচ্ছে, ‘বনপার্টি’ (স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ মাওবাদীদের যে নামে সম্বোধন করেন)-কে আশ্রয় দেওয়ার পিছনে শুধু ভয়ভীতি নেই, সমর্থনও আছে পুরোদস্তুর।
সমতলের কিছু গ্রামে এই ধরনের সমর্থনে বলীয়ান হয়েই মাওবাদীরা ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যখন-তখন অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে এসে হামলা চালিয়ে গা ঢাকা দিতে পারত। তা হলে কি এখন গ্রামে গ্রামে নতুন করে মাওবাদীদের জনসমর্থনের ভিত তৈরি হচ্ছে?
মানতে নারাজ সৃষ্টিধর মাহাতো, “কয়েক জন মাওবাদী উদ্ভ্রান্তের মতো অযোধ্যার পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সমতলের কয়েকটি গ্রামে থাকা ওদের ‘সাপ্লাই লাইন’ আমরা কেটে দিয়েছি। সে জন্যই ওরা সাফ হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়া থেকে।”
মুখে এটা বললেও জঙ্গলমহলের এই দাপুটে তৃণমূল নেতা কিন্তু নিজের গ্রামের বাড়িতে নিজের সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়েও নিশ্চিন্ত নন! অযোধ্যা পাহাড় থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে, বড় উরমা গ্রাম পঞ্চায়েতের খইরাডি গ্রামে সৃষ্টিধরের বাড়ি। লাগোয়া খামারবাড়ির একতলায় তাঁর আট নিরাপত্তারক্ষীর থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত। প্রত্যেকেই রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের। সবারই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ কে-৪৭, ইনস্যাস, নাইন এমএম। কিন্তু খামার বাড়িটা দেখিয়ে সৃষ্টিধর বললেন, “বাড়িটা অবিলম্বে দোতলা করতে হবে। একতলায় দেহরক্ষীদের থাকা নিরাপদ নয়।” তা হলে জঙ্গলমহল হাসছে বলে সরকার ও শাসক দলের একেবারে শীর্ষস্তর থেকে যে অহরহ দাবি করা হচ্ছে?
এ বার চোয়াল শক্ত সৃষ্টিধরের। দু’টো চোখ সরু করে বলেন, “গ্রামে গ্রামে মাওবাদীদের কয়েক জন পুরনো লিঙ্কম্যান এখনও দিব্যি সক্রিয়। অযোধ্যা পাহাড়ে ঘাঁটি গাড়া মাওবাদীদের মধ্যে আছে এখানকার মণ্ডল কেরুয়া গ্রামের হলধর গরাঁই।” গোটা পনেরো খুনের মামলায় অভিযুক্ত হলধর আজও অধরা। সেপ্টেম্বরেই সৃষ্টিধরের গ্রাম খইরাডি থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যে বড় উরমায় তৃণমূল পার্টি অফিসের কাছে এবং সাত কিলোমিটার দূরে ঘাটবেড়া-কেরুয়া পঞ্চায়েত অফিসের সামনে মিলেছে মাওবাদী পোস্টার-ব্যানার।
সৃষ্টিধরের সাফ কথা, “অযোধ্যা পাহাড়ে থাকা মাওবাদী নেতাদের নির্দেশেই ব্যানার-পোস্টার ফেলেছে স্থানীয় লিঙ্কম্যানেরা। আমরা কিছুতেই জনা কুড়ি মাওবাদী লিঙ্কম্যানকে বাগে আনতে পারছি না।” আর দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন মাহুলিটাঁড় প্রমাণ করেছে, দানছত্রেও চিঁড়ে ভিজবে না।
পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অবশ্য ‘এই রোগের’ নিদান ভেবেছেন। তাঁর মতে, অযোধ্যা পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও শুধু দুর্গম নয়, প্রায় অগম্য এবং যার সুযোগ মাওবাদীরা নিচ্ছে। সৃষ্টিধরের বক্তব্য, শিরকাবাদ থেকে বাঘমুণ্ডি পর্যন্ত পাকা রাস্তা দিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের উত্তর ও দক্ষিণকে জোড়া হয়েছে। তাঁর কথায়, “এ বার অযোধ্যা পাহাড়ের মাথা থেকে ঝালদার খামার পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি। যার ফলে জুড়ে যাবে অযোধ্যা পাহাড়ের পূর্ব ও পশ্চিম দিক। এবং মাওবাদীদের আনাগোনা আরও কমবে।”
কিন্তু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করেই কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? অসুখ যে আরও গভীরে!
(চলবে)