নয়াদিল্লির বাড়িতে মুকুল রায়।—নিজস্ব চিত্র।
সিবিআইয়ের ডাক পেয়ে দু’দিন আগে দিল্লিতে বসে বলেছিলেন, কলকাতায় গিয়েই হাজিরা দেবেন। বুধবার কলকাতায় এসে বললেন, পনেরো দিন সময় চাই। সিবিআই সাত দিন সময় দিল। সময় হাতে পেয়েই বৃহস্পতিবার সাতসকালেই ফের দুম করে দিল্লি চলে গেলেন মুকুল রায়।
সারদায় মামলায় সিবিআই মুকুল অবধি পৌঁছে যাওয়ার পরে দৃশ্যতই দিশাহারা তৃণমূল নেতৃত্ব। যেনতেনপ্রকারে বাঁচার রাস্তা খুঁজতেই আবার দিল্লি দৌড়েছেন মুকুল, দলীয় সূত্রের এমনটাই দাবি। ওই সূত্রের বক্তব্য, মূলত দু’টি রাস্তার খোঁজ চলছে। এক, রাজনৈতিক। অর্থাৎ, দিল্লিতে বিজেপি নেতাদের ধরে সিবিআইয়ের উপরে লাগাম পরানো যায় কি না। দুই, আইনি। নামজাদা আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে দেখা, সিবিআই গ্রেফতার করতে চাইলে সেটা ঠেকানোর কোনও উপায় আছে কি না।
মুকুল নিজে অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই সারদা সামলাতে দিল্লি আসার কথা কবুল করেননি। তাঁর দাবি, “আমি রাজনৈতিক কাজে এসেছি। বনগাঁ এবং কৃষ্ণগঞ্জ এই দু’টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই কাজেই আমার এখানে আসা।” যা শুনে বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের কটাক্ষ, “নির্বাচন তো রাজ্যে। তা হলে উনি দিল্লি গেলেন কেন!” মুকুলের পাল্টা ব্যাখ্যা, “আমি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ভাই। উপনির্বাচন শুধু এখানে নয়, ভারতের সর্বত্র আছে।” পশ্চিমবঙ্গে ঘোর সঙ্কটে থাকা দল দেশের অন্যত্র উপনির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, এমন খবর অবশ্য তৃণমূল সূত্রে নেই।
বরং দলীয় নেতাদের যাবতীয় চিন্তা সারদা নিয়েই। এবং তাঁরা বলছেন, রেলমন্ত্রী থাকাকালীনও যে মুকুল কার্যত দিল্লিমুখো হতেন না, সেই তিনিই এখন ঘনঘন সেখানে ছুটছেন। মুকুলের দিল্লিযাত্রার একটা কারণ যে বিজেপি নেতাদের দ্বারস্থ হওয়া, তা-ও জানাচ্ছেন তাঁরা। সারদা কেলেঙ্কারি তৃণমূলের উপর ছায়া ফেলতে শুরু করার পর থেকেই মুকুল বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন। এর আগে তিনি দেখা করেছেন রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলিদের সঙ্গে। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজেপি যে মুকুলকে সাহায্য করবে, এমন সম্ভাবনা কম। কারণ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে মসনদ দখল করতে চাইছে তারা। ফলে তৃণমূলের নেতাদের রাজনৈতিক ভাবে সাহায্য করার প্রশ্ন ওঠে না। তবু খড়কুটো আঁকড়ানোর মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তৃণমূলের তরফে।
আর আইনি পথ? সেখানেও জটিলতা বিস্তর।
প্রথম প্রশ্ন, সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে যদি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হয়, তা হলে আর্জিটা জানাবে কে? মুকুল রায়, তৃণমূল কংগ্রেস না রাজ্য সরকার?
এই বিষয়ে পরামর্শ করতে দুঁদে আইনজীবী কপিল সিব্বলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মুকুলরা। সূত্রের খবর, কপিলই পরামর্শ দেন, সিবিআই-এর বিরুদ্ধে মামলা করলে রাজ্যকেই করতে হবে। মুকুল বা অন্য কেউ ব্যক্তিগত মামলা করলে শীর্ষ আদালতে তা ধোপে টিকবে না। আবার তৃণমূলের তরফে মামলা করা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে তৃণমূলের স্বার্থ কী? কিন্তু রাজ্য মামলা করে বলতে পারে যে, রাজনৈতিক ভাবে সিবিআই-এর অপব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাজ্যের গ্রেফতার হওয়া এক মন্ত্রীকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। বৃহস্পতিবারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নষ্ট করতে কেন্দ্রীয় সরকারের এ ভাবে রাজ্য সরকারকে বুলডোজ করা উচিত নয়’।
বস্তুত, কাল, শনিবারই রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে অন্তর্বর্তিকালীন আবেদন (ইন্টেরিম পিটিশন) দাখিল করতে চলেছে বলে নবান্ন সূত্রের খবর। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত এ নিয়ে নবান্নে বৈঠক করেন প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। এই জল্পনা উস্কে এ দিন মুকুলের সঙ্গে দিল্লি গিয়েছেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও।
রাজ্যের আইন ও বিচার দফতর সূত্রের খবর, আপাতত ঠিক হয়েছে, সারদা-মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ধরেই অন্তর্বর্তিকালীন আবেদন জমা দেবে সরকার। কী সেই পথ? ওই দফতরের এক কর্তা বলেন, সারদা-তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার সময় সর্বোচ্চ আদালত বলেছিল, এখনই আমরা তদন্তে নজরদারির কথা ভাবছি না। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে ভাবা যাবে। রাজ্য সরকার ওই পথেই সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চেয়ে আবেদন করার কথা ভাবছে।
কিন্তু এই পথে হেঁটে ফল হবে কি না, তা নিয়ে নবান্নের কর্তাদের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্য সরকার যদি মামলা করে, তা হলে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চলার অভিযোগ তোলা যাবে না। তার চেয়ে তৃণমূল দলগত ভাবে মামলা
করে, তা হলে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চলার অভিযোগ তোলা যাবে না। তার চেয়ে তৃণমূল দলগত ভাবে মামলা করে সে কথা বলাই ভাল। আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় এর আগে তেমনই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য ঠিক হয়েছিল, তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ কেউ মামলা করবেন।
কপিলকে দিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে মামলা করানোর আরও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরছেন অনেকে। যেমন, রাজ্য যদি মামলা করে, তা হলে তারা মদন মিত্রকে নিয়েই শুধু কথা বলতে পারবে। মুকুল রাজ্য সরকারের কেউ নন। ফলে এই মামলায় তিনি আলাদা করে কতটা সুবিধা পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দুই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদার তদন্ত করছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাজের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার মামলা করলে কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা।
তিন, প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এখন কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বলের পক্ষে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে সওয়াল করাটা নীতিগত ভাবে কতটা ঠিক হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
তৃণমূল দল বা তার ঘনিষ্ঠ কারও হয়ে মামলা লড়তে যে কপিল তেমন আগ্রহী নন, সেই ইঙ্গিত তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে দিয়েছেন। তৃণমূল নেতাদের খানিকটা এড়াতেই তিনি জানান, মামলা লড়ার ফি নেবেন চেকেই। দুঁদে আইনজীবী কপিলের ফি যা হবে, তা চেকে মেটানো কতটা সম্ভব, তা নিয়ে তৃণমূলেই সংশয় আছে। রাজ্য আসরে নামলে অবশ্য সে সমস্যা নেই।
তবে সিবিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের অভিযোগ ফের উড়িয়েছে কেন্দ্র। তাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা তৃণমূলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে জড়িত এবং সুবিধাপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। ত্রিপুরা-ওড়িশাতেও তদন্ত হচ্ছে। সিবিআই সূত্রের দাবি, সারদায় আরও চার্জশিট দিতে মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
মুকুল এবং তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারির দাবিতে হাজরা থেকে এক্সাইড মোড় পর্যন্ত মিছিল করে দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেস। আব্দুল মান্নান বলেন, “দিল্লি যাওয়া নিয়ে মুকুলবাবু এত গোপনীয়তা রাখছেন কেন? কেউ কেউ বলছেন, দিল্লি সরকারের সাহায্য নিয়ে উনি বিদেশেও পালাতে পারেন।” তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দিল্লিই দলের প্রধান কার্যালয়। মুকুল সাংসদও। ফলে ওঁর দিল্লি যাওয়ায় সন্দেহজনক কী রয়েছে?”