মমতাকে চিঠি, দল ছাড়ার হুমকি সিউড়ি বিধায়কের

এ যেন হঠাৎ বিদ্রোহের আগল খুলে যাওয়া। আত্মসমালোচনার ঢঙে তপন চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, শুভেন্দু অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদীরা দলকে খোঁচা দিচ্ছিলেনই। মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর তো দল ছেড়ে বিজেপিতে চলেই গিয়েছেন। এ বার দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুললেন সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপন ঘোষ।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১১
Share:

এ যেন হঠাৎ বিদ্রোহের আগল খুলে যাওয়া।

Advertisement

আত্মসমালোচনার ঢঙে তপন চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, শুভেন্দু অধিকারী, দীনেশ ত্রিবেদীরা দলকে খোঁচা দিচ্ছিলেনই। মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর তো দল ছেড়ে বিজেপিতে চলেই গিয়েছেন। এ বার দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুললেন সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপন ঘোষ।

আর ব্যবস্থা নেওয়া যদি না হয়? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে তাঁর হুমকি, “আমাকে অনন্যোপায় হয়ে অন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

Advertisement

বিধায়কের হুমকি চিঠিতে কার্যত কাঁপুনি ধরেছে তৃণমূলে। অনেকেরই প্রশ্ন, শুধু কি স্বপন ঘোষ? নাকি ‘অন্য সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার জন্য তলে তলে আরও অনেকে তৈরি হয়ে আছেন? যদিও যাঁর চিঠি নিয়ে এত হইচই, সেই স্বপনবাবু এ নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য, “বন্ধ খামে মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠি নিয়ে কিছু বলব না।” বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন? স্বপনবাবুর জবাব, “আপাতত এমন পরিকল্পনা নেই। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করব।”

স্বপনবাবু মুখে যা-ই বলুন, খোদ তৃণমূল ভবনই মানছে, এ হল ভাঙনের সলতে পাকানোর পর্ব। দলের এক শীর্ষ নেতা জানাচ্ছেন, পূর্বস্থলীর বিক্ষুব্ধ বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় আয়োজিত একটি মেলার উদ্বোধনে গিয়ে কিছু দিন আগেই স্বপনবাবু দলীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করেছিলেন। সেই সভায় তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও ছিলেন। তার পরেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন সিউড়ির বিধায়ক। দলীয় সূত্রের খবর, এর পর দলের তরফে সুব্রত বক্সী তৃণমূল ভবনে ডেকে স্বপনবাবুর ক্ষোভের কথা শুনেছেন। কিন্তু রফাসূত্র বেরোয়নি। ফলে দিন যত এগোচ্ছে, ওই বিধায়ক ততই ‘অন্য সিদ্ধান্তের’ দিকে এগোচ্ছেন বলে মনে করছে শাসক দলের অন্দরমহল। এ প্রসঙ্গে দলের সভাপতি সুব্রতবাবু অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানাননি।

কেন দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেলেন স্বপনবাবু? দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন এই বিধায়ক। তাঁর দাবি, জল প্রকল্প এবং বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ১০ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা সিউড়ি পুরসভা থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে স্বপনবাবু লিখেছেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ১০ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা পুরসভা থেকে বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় পুরসভার তৃণমূলী চেয়ারম্যান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় এবং অন্য দলীয় কাউন্সিলারদের ভূমিকা নিয়ে নানা কুকথা শোনা যাচ্ছে। দলীয় বিধায়ক হিসেবে এর কালিমা থেকে আমিও মুক্ত হতে পারছি না।”

মুখ্যমন্ত্রীকে লেখার আগে দলীয় স্তরে কেলেঙ্কারির কথা জানিয়েও যে বিশেষ লাভ হয়নি, তা নিয়েও ক্ষোভ চেপে রাখেননি বিধায়ক। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, গরমিলের কথা আঁচ করে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সুডা) কাছে অন্তত ৫টি চিঠি লিখেছিলেন। একটিরও জবাব পাননি। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে স্বপনবাবুর দাবি, ‘২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূল ভবনে মুকুল রায়, রজত মজুমদার, ফিরহাদ হাকিম, শতাব্দী রায়কে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে আমিও ছিলাম। বৈঠকে পুরমন্ত্রী জানান, ঘটনার তদন্ত হলে চেয়ারম্যানের জেল হবে। তখনই পুর চেয়ারম্যানকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুকুলবাবু।’ স্বপনবাবুর বক্তব্য, বৈঠকে থাকার কথা থাকলেও ছিলেন না চেয়ারম্যান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। তিনি ইস্তফা দেননি। এর প্রতিফলন গত লোকসভা ভোটেও পড়েছে বলে স্বপনবাবুর দাবি। তিনি লিখেছেন, ‘লোকসভা ভোটে শহরের ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে আমরা বিজেপির থেকে পিছিয়ে পড়েছি। বিজেপি শহরে ২৪৩২ ভোটে আমাদের প্রার্থীকে পরাজিত করেছে।’

অভিযোগ নিয়ে পুরচেয়ারম্যান কী বলছেন? উজ্জ্বলবাবুর দাবি, “কোনও কেলেঙ্কারি হয়নি। এখন পুরসভার মাসে আয় ১০ লক্ষ টাকা আর ব্যয় ২৫ লক্ষ টাকা। বাধ্য হয়েই জলপ্রকল্পের টাকা ভেঙে পুরকর্মীদের বেতন-পেনশন মেটানো হয়েছে... তা সরকারকে জানানো হয়েছে।” টাকা নেই বলে দু’মাস পুরকর্মীদের বেতন হচ্ছে না। বিধায়ক সেই খবর নিয়েছেন কি, প্রশ্ন উজ্জ্বলবাবুর। বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “কর্মচারীদের বেতন তো বন্ধ করা যায় না। ফলে জলপ্রকল্পের টাকা ভেঙে বেতন দেওয়া হয়েছে, কোনও কেলেঙ্কারি হয়নি।”

স্বপনবাবু কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে লিখেছেন, দুর্নীতি দমনে তিনি শেষ বারের মতো দলকে সক্রিয় হতে অনুরোধ করছেন। স্বপনবাবুর বয়ানে, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি এবং সিউড়ি পৌরসভা এলাকায় জলপ্রকল্প নিয়ে সদর্থক উদ্যোগ আহ্বান করছি। এ নিয়ে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না হলে আমাকে অনন্যোপায় হয়েই অন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

স্বপনবাবু এই চিঠির প্রতিলিপি পাঠিয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ এবং অনুব্রত মণ্ডলকেও। উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সফররত পুরমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলছেন, “চিঠি দেখিনি। স্বপনের কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। আমি ওই জেলার দলের পর্যবেক্ষক। ওঁর সঙ্গে কথা বলে নেব।” মৎস্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “নানা কথা শুনছি, কিন্তু কোনও চিঠি পাইনি। ফলে এ নিয়ে কোনও কথা বলব না।” বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায়ের বক্তব্য, “স্বপনবাবু চিঠি দিয়েছেন। তাঁর কাছেই এ ব্যাপারে জানুন।”

আর অনুব্রত রাখঢাক না-করেই বলছেন, “স্বপন থাকলেন কি গেলেন তাতে কিছু যায় আসে না। ওঁর জন্য দলের কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement