মিৎসুবিশির সঙ্কটে সাহায্যের হাত মোদীর

এ রাজ্যে মিৎসুবিশিকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যের শিল্পশহর হলদিয়ায় প্রথম বিদেশি লগ্নিকারী এই সংস্থা লোকসানে ধুঁকতে থাকায় ইতিমধ্যেই বিআইএফআর (বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন)-এর দ্বারস্থ হয়েছে। খরচে রাশ টেনে এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে কাঁচামাল আমদানির জন্য হুগলি নদীতে নিজস্ব জেটি করতে চায় জাপানের এই সংস্থাটি। তাদের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব পাঠানো হয় হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৪৩
Share:

এ রাজ্যে মিৎসুবিশিকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

রাজ্যের শিল্পশহর হলদিয়ায় প্রথম বিদেশি লগ্নিকারী এই সংস্থা লোকসানে ধুঁকতে থাকায় ইতিমধ্যেই বিআইএফআর (বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশন)-এর দ্বারস্থ হয়েছে। খরচে রাশ টেনে এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে কাঁচামাল আমদানির জন্য হুগলি নদীতে নিজস্ব জেটি করতে চায় জাপানের এই সংস্থাটি। তাদের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব পাঠানো হয় হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। তাতে সায় দেননি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ কথা জানতে পেরে জাহাজ মন্ত্রককে হস্তক্ষেপ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বুঝিয়ে দেন, তাঁর কাছে হলদিয়া বন্দরের লাভ-লোকসানের অঙ্কের থেকে জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই মতো মিৎসুবিশিকে অবিলম্বে জেটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি দিতে হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে নিতিন গডকড়ির মন্ত্রক।

সূত্রের খবর, রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী সংস্থার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে আগামী শুক্রবার কারখানা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন হলদিয়া বন্দরের ডেপুটি চেয়ারম্যান মণীশ জৈন। ২৯ অক্টোবর কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছে জাহাজ মন্ত্রক। সেই বৈঠকেও মিৎসুবিশির প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হবে বলে মন্ত্রক সূত্রের খবর।

Advertisement

মিৎসুবিশির রুগ্ণ দশার কথা কী ভাবে জানলেন প্রধানমন্ত্রী?

জাহাজ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সেপ্টেম্বর মাসে জাপান সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সে দেশের তাবড় শিল্পকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় মিৎসুবিশির কর্তাদের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়। তাঁরা তখন প্রধানমন্ত্রীকে হলদিয়ার কারখানার বেহাল দশার কথা জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল, দিনদিন যে ভাবে লোকসানের বহর বাড়ছে, তাতে হলদিয়ার কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে সংস্থাকে। বস্তুত, এই বৈঠকের অনেক আগেই নিজেদের রুগ্ণ বলে বিআইএফআর-এর দ্বারস্থ হয়েছে সংস্থাটি। কারখানাটি বাঁচাতে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে যে সে ভাবে সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না, সেই প্রসঙ্গও আলোচনায় ওঠে।

কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছিল সংস্থাটি? সংস্থা সূত্রে বলা হয়েছে, এক দিকে স্থানীয়দের চাকরি দেওয়ার জন্য নিত্য চোখরাঙানি, অন্য দিকে বেতন সংশোধনের জন্য শ্রমিক সমস্যা। গত বছর দুয়েক ধরে প্রতিযোগিতার বাজারে ইন্দোনেশিয়া, চিন, তাইল্যান্ডের কাছে মার খাচ্ছিল সংস্থাটি। তার উপর এই ধরনের স্থানীয় সমস্যার ফলে চাপ বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের বেতন সংক্রান্ত দাবিদাওয়া নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা মেটাতে রাজ্য সবে চেষ্টা শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার শ্রমমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে একটি শ্রমিক ও সংস্থা কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতাসূত্র বার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তত দিনে দু’পক্ষের সম্পর্ক অনেকটাই তলানিতে চলে গিয়েছে। এর উপরে বিষফোড়া হিসেবে কাজ করেছে বিশ্ব বাজারে মন্দা এবং বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রবেশ কর চাপানোর সিদ্ধান্ত। সব মিলিয়ে লোকসান উত্তরোত্তর বেড়েছে। সংস্থা সূত্র বলছে, লোকসানের বহর এতটাই হয়ে গিয়েছে যে বিআইএফআর-এ যাওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।

এখন সংস্থা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে লোকসান কমাতে চাইছে। তারই অন্যতম নিজস্ব জেটি তৈরি। জাহাজ মন্ত্রক সূত্রে খবর, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর এ দেশে মিৎসুবিশির কর্তারা এই প্রস্তাবটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও জাহাজ মন্ত্রককে জানান। প্রস্তাব দ্রুত বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জাহাজ মন্ত্রকের কাছে নির্দেশ যায়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বক্তব্য ছিল, মিৎসুবিশির আমদানি করা কাঁচামাল নিয়ে জাহাজ হলদিয়া বন্দরে ভিড়লে তাদের বছরে কয়েক কোটি টাকা আয় হয় ঠিকই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারত-জাপান বন্ধুত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিৎসুবিশির এই কারখানাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সব রকম ভাবে সাহায্য করা প্রয়োজন। ঘনিষ্ঠমহলে প্রধানমন্ত্রী জানান, ভারতের সর্ববৃহৎ জাপানি বিনিয়োগকারী সংস্থাটি সমস্যায় পড়লে ভবিষ্যতে সে দেশ থেকে লগ্নি আসার ব্যাপারে প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হতে পারে। তাই জাহাজ মন্ত্রককে সব রকম সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয় তাঁর দফতর।

পরিস্থিতি বুঝে হলদিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষও এখন মিৎসুবিশির সঙ্গে সহযোগিতার পথে হাঁটতে চাইছে। বুধবার বন্দরের এক কর্তা বলেন, “মিৎসুবিশি নিজেরা জেটি করতে চাইছে। এটা ভাল কথা। মিৎসুবিশির পেট্রোপণ্যের বদলে অন্য পণ্য খালাস হবে বন্দরে। তাতে রাজস্ব বাড়ার সুযোগ বাড়বে বই কমবে না। সেই কারণেই শুক্রবার তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে।”

মিৎসুবিশি কারখানায় পিউরিফায়েড টেরিপথলিক অ্যাসিড (পিটিএ) তৈরির কাঁচামাল হিসেবে প্যারাজাইলিন এবং অ্যাসিটিক অ্যাসিড আমদানি করা হয়। বছরে ৭ থেকে ৮ লক্ষ টন কাঁচামাল হলদিয়া বন্দর মারফত নিয়ে আসে জাপানি সংস্থাটি। এ জন্য অন্তত ১০০টি জাহাজ বন্দরে আসে। পণ্য আমদানি করার জন্য ডকের মধ্যে বার্থের ভাড়া, খালাসের খরচ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে জাহাজপিছু ১৭ থেকে ২০ লক্ষ টাকা আদায় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে শুধুমাত্র মিৎসুবিশির কাঁচামাল আমদানি করেই বছরে ১৭ থেকে ২০ কোটি টাকা রাজস্ব আসে বন্দরের ঘরে। সেই রাজস্ব হারানোর ভয়েই এত দিন মিৎসুবিশিকে আলাদা জেটি তৈরির প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়নি বলে বন্দর সূত্রে খবর।

সংস্থার বক্তব্য, এ ছাড়াও স্যান্ডহেডে জাহাজ দাঁড় করিয়ে রাখার খরচ আছে। সংস্থার এক কর্তা জানান, হলদিয়া বন্দরের বার্থে জায়গা মেলার আগে সাগরের কাছে স্যান্ডহেডে প্রতিটি জাহাজকে বেশ কিছু দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অথচ স্যান্ডহেডে ২৪ ঘণ্টার বেশি দাঁড়ালেই জাহাজপিছু প্রতিদিন গুনাগার দিতে হয় ১৬ থেকে ১৮ হাজার মার্কিন ডলার। নিয়ম অনুযায়ী, একে ‘ড্যামারেজ চার্জ’ বলা হয়। নিজস্ব জেটি হলে আমদানি বাবদ জাহাজ ভাড়া ও পণ্য খালাসের খরচ অর্ধেকেরও কম হবে, আর ‘ড্যামারেজ চার্জ’ও লাগবে না। সব মিলিয়ে ২০-২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ।

সংস্থার এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, পৃথক জেটি তৈরির অনুমোদন মিললে ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে তা তৈরি করা যাবে। জেটি-টি তৈরি হবে কারখানার কাছে। ফলে প্যারাজাইলিন বা অ্যাসিটিক অ্যাসিডের মতো পণ্য নামি সংস্থার ওই শীর্ষ কর্তার কথায়, “এই খরচ কমাতে পারলে অনেকটাই সুবিধা হবে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও জাহাজ মন্ত্রকে সেই কারণেই দরবার করা হয়েছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement