রাজ্য বাজেটের দিন বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, বিদ্যুতের মাসুল কমতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার দু’সপ্তাহের মাথায় তাঁর বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত স্পষ্ট করে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার গ্রাহকদের বিদ্যুৎ-মাসুল খুব শিগগিরই কমাতে চলেছে সরকার।
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, আগামী অর্থবর্ষে (২০১৪-১৫) বিদ্যুতের গড় মাসুল ইউনিটপিছু পাঁচ থেকে দশ পয়সা কমতে পারে। ঠিক কতটা কমবে?
বিদ্যুৎমন্ত্রী অবশ্য তা এখনও জানাতে পারেননি। রবিবার মণীশবাবু বলেন, “কতটা কমবে, সেটা এখনও ঠিক হয়নি। তবে মাসুল হ্রাসের বিজ্ঞপ্তি বেরিয়ে যাবে আগামী মাসের মধ্যে।” গ্রাহকের মাসুল কমলে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোর আয়ও কমবে। উপার্জনের সেই ঘাটতি সরকার কী ভাবে সামাল দেবে, বিদ্যুৎমন্ত্রী এ দিন অবশ্য সে ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি।
২০১১-য় পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিদ্যুতের মাসুল বাড়ানো যাবে না। মাসুলবৃদ্ধিতে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি না-থাকায় বণ্টন কোম্পানি প্রবল আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে। পরে অবশ্য মাসুলবৃদ্ধির প্রস্তাবে অনুমোদন মেলে। তাতে কিছুটা সুরাহার মুখ দেখা গেলেও এখন ফের মাসুল ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত শুনে প্রশাসনের একাংশে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে ভোট-রাজনীতিরও ছায়া দেখছে কিছু মহল। এ হেন জনপ্রিয় পথে হাঁটতে গিয়ে বণ্টন কোম্পানি ফের বড়সড় অর্থসঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারে বলে এই মহলের আশঙ্কা।
ঘটনা হল, রাজ্য সরকার এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে খরচ কমাতে তৎপর। যে কারণে সরকারি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ে লাগাম পরানোর চেষ্টা চলছে। এ দিন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের ইঞ্জিনিয়ার ফোরাম আয়োজিত ‘এনার্জি পাওয়ার সিনারিও ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে নিগমের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর দুর্গাদাস গোস্বামী বলেন, “বেসরকারি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপিছু ব্যয় এক টাকা। সরকারি ক্ষেত্রে তা ২ টাকা ২৫ পয়সা। এই খরচটা কমিয়ে আনাই আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ।” রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তাদের দাবি: আগামী অর্থবর্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এক টন কয়লাও বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে না। পরিবর্তে সস্তার দেশি কয়লা ব্যবহার করা হবে। সস্তার কয়লায় যাতে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সেই প্রযুক্তিও তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি কমানো হবে অন্যান্য জ্বালানির খরচ।
এবং এ সবের দৌলতে সরকারি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কয়েকশো কোটি টাকা নামিয়ে আনা যাবে বলে দফতরের আশা। তাঁরা বলছেন, সেই সাশ্রয়েরই সুবিধা গ্রাহকদের একাংশকে দেওয়া হবে, মাসুল হ্রাসের মাধ্যমে। ফলে আর্থিক সঙ্কটের আশঙ্কা থাকবে না বলে সরকারি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। ভিন্ন সুরও শোনা যাচ্ছে। কী রকম?
বিভিন্ন বিদ্যুৎ সংস্থার কর্তাদের কারও কারও বক্তব্য, এতে আখেরে সরকারি বিদ্যুৎ-শিল্পের ক্ষতিই হবে। ওঁদের কথায়, “বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ে রাশ টানার প্রস্তাব ভাল। তাতে সংস্থার পুঁজি বাড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে মাসুল কমিয়ে দেওয়া হলে কাজের কাজ কিছু হবে না।” এই মহলের মতে, গ্রাহকদের থেকে মাসুল আদায় করে ভাঁড়ারে যে টাকা আসে, তা দিয়ে সংস্থার আর্থিক হাল ফেরানো যায়। মাসুল আদায়ে টান পড়লে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎমন্ত্রী এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি কেন্দ্রের দিকে বঞ্চনার অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। “সারা দেশে ব্যবহৃত কয়লার আশি ভাগই আমাদের রাজ্যে উৎপাদিত। অথচ আমাদেরই বাইরে থেকে কয়লা কিনতে হয়!” আক্ষেপ করেছেন মণীশবাবু। তাঁর অভিযোগ, “দেশ জুড়ে কয়লা-মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের দাবি কেন্দ্রীয় সরকার মানেনি। তা ছাড়া বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনা গেলে আমরা কিছুটা লাভবান হতাম। কেন্দ্র তাতেও বাধা দিচ্ছে।”
দিল্লির দরবারে এমন নানা দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী।