রোজই জনসভায় কিংবা ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলের নেতাদের মুন্ডুপাত করছেন তিনি। কিন্তু নতুন বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছার মর্যাদা দিয়ে সৌজন্যের লড়াইয়ে এক কদম এগিয়ে গেলেন নরেন্দ্র দামোদর মোদী।
মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন তাঁর নিজের নিরাপত্তায় রেলরক্ষী বাহিনীর (আরপিএফ) অফিসার এবং জওয়ানদেরই ফের বহাল রাখুক কেন্দ্রীয় সরকার। মমতার সেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। তাঁর পছন্দের রেলরক্ষী বাহিনীকে আপাতত আর রেলে ফিরতে হচ্ছে না।
কেন্দ্র তাঁর আর্জি মেনে নেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী খুশি হলেও, স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের বড় একটা অংশ অবশ্য খুশি হতে পারছেন না। তাঁদেরই এক জনের মন্তব্য, নিজের রাজ্যের পুলিশের উপর যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতার আস্থা নেই, তা বুঝতে পেরেছেন মোদী। তাই সেই ইচ্ছেপূরণ করতে সময় নেননি তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্যের ভিভিআইপি-দের নিরাপত্তার ভার সিকিউরিটি ডাইরেক্টরেটের। এখানে ৫০০ জন অফিসার-কর্মী রয়েছেন। রাজ্য পুলিশের এই শাখাকে স্পেশ্যাল সিকিউরিটি উইং বা এসএসডব্লু বলা হয়। মমতা কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তাঁর নিরাপত্তায় আরপিএফ মোতায়েন ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তার বদল হয়নি। তবে ধাপে ধাপে আরপিএফ অফিসারদের সংখ্যা কমানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময়ে মমতার সঙ্গে থাকতেন ৭৫ জন আরপিএফ অফিসার-কর্মী। সেটা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৯ জনে (১ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সিকিউরিটি কমিশনার, ৩ জন হেড কনস্টেবল এবং ৫ জন কনস্টেবল)।
নবান্নের খবর, এই ৯ জন অফিসার-জওয়ানেরই রাজ্যে ডেপুটেশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে বুধবার। ঠিক তার আগেই দিল্লি থেকে অনুমোদন চলে এসেছে। ৯ জনের মধ্যে দু’জন নিজেরা রেলে ফিরতে চেয়েছেন। তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বাকি ৭ জন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই থেকে যাচ্ছেন।
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক অফিসার জানাচ্ছেন, তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে মমতার নিরাপত্তায় আরপিএফ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। মেয়াদ ফুরোনোর দু’মাস আগেই অক্টোবরে রাজ্যের তরফে আরপিএফের ডিজি কৃষ্ণ চৌধুরীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে ওই অফিসারদের রেখে দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল। রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর কাছে ফাইল পাঠিয়ে সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলেন ডিজি। রেলমন্ত্রী নিরাশ করেননি। আরপিএফ সূত্রের খবর, রেল থেকে রাজ্যে ডেপুটেশনে গেলে তিন বছর পর ফিরে যেতে হয়। এটাই চালু নিয়ম। তবে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সেই মেয়াদ আরও দু’বছর বাড়তে পারে। আরপিএফের এক কর্তা জানাচ্ছেন, “এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মতামত নিয়েছেন রেলমন্ত্রী। মোদীজি এত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কোনও সঙ্কীর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চাননি। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় আমাদের সাত জন অফিসার-জওয়ান বহাল থাকছেন।”
এ প্রসঙ্গে আরপিএফের আইজি পি কে ঢাকা বলেন, “রাজ্য সরাসরি মন্ত্রকে আবেদন জানিয়েছিল, দিল্লিও রাজ্যকে উত্তর দিয়ে দিয়েছে।” আর মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র বলেন, “এখনও নির্দেশনামা দেখিনি। কিন্তু জেনেছি, রেল মন্ত্রক আরপিএফ জওয়ান-অফিসারদের ডেপুটেশনের সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে।”
কিন্তু যে মমতা ইদানীং কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে এত ক্ষুব্ধ, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে এত সরব, যে মমতা রাজ্যে নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি এখনও নিজের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল থাকছেন কেন? রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “মমতার নিরাপত্তার গুরুত্ব প্রধানমন্ত্রী বোঝেন বলেই আরপিএফ বহাল রেখেছেন। কিন্তু রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বলুন, কেন তাঁর পুলিশে ভরসা নেই?” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র আবার কটাক্ষ করছেন, “রতনে রতন চেনে! বাইরে এত কোস্তাকুস্তি চলছে, ভিতরে তো বেশ দোস্তি! সিবিআই একাই ষড়যন্ত্র করছে, আরপিএফ করছে না?” উত্তরে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সূর্যবাবু নিজে এক রতন, আর এক রতন রাহুলবাবুকে চিনেছেন! এর মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্যের ব্যাপার নেই, এর মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্যের ব্যাপার নেই, ঢাকঢাক গুড়গুড়ও নেই। মমতা দেশের অন্যতম প্রধান জননেত্রী। তাঁর সুরক্ষার ব্যাপারটা সিকিউরিটি এজেন্সিই ঠিক করে।”
আর, স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, “গত তিন বছরে এই ন’জনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ভাল রকম বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। তাই ডেপুটেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এঁদেরই রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।”
শুধু সংশয় ছিল, নবান্ন থেকে আরপিএফ-কে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব গেলে মোদী সরকার রাজি হবে কি না। আরপিএফের এক কর্তার মতে, সাধারণ ভাবে মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা কম থাকে। তা ছাড়া রেলরক্ষী বাহিনী নেওয়া হলে তার খরচ বহন করার কথা রাজ্য সরকারের। গত তিন বছর ধরে মমতা সরকার সেই খরচও বকেয়া রেখেছে বলে ওই অফিসারের দাবি। যদিও স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “বকেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, ওই অফিসার-জওয়ানদের বেতনের টাকা রাজ্যই মেটায়।”