মেঘলা দুপুরে ‘ভিআইপি’ ঝড়, তটস্থ মহাকরণ

তিনি এলেন, দেখলেন, ভিরমি খাইয়ে, ঝড় উড়িয়ে চলেও গেলেন। পিছনে রেখে গেলেন হতভম্ব কিছু পুলিশকর্মী, কিছু সরকারি কর্মী-অফিসারকে।বছরের শেষ দুপুর। রোদহীন। ‘এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা’ মেজাজে রাজ্যের সাবেক সচিবালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে সময় কাটছিল পুলিশ অফিসারদের। রাজ্য প্রশাসনের কন্ট্রোলরুম গঙ্গা পেরোনোর পর থেকে শতাব্দীপ্রাচীন লালবাড়ির ডিউটিতে আগের মতো ব্যস্ততা নেই তাঁদের। চলছিল টুকটাক গল্প।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৮
Share:

তিনি এলেন, দেখলেন, ভিরমি খাইয়ে, ঝড় উড়িয়ে চলেও গেলেন। পিছনে রেখে গেলেন হতভম্ব কিছু পুলিশকর্মী, কিছু সরকারি কর্মী-অফিসারকে।

Advertisement

বছরের শেষ দুপুর। রোদহীন। ‘এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা’ মেজাজে রাজ্যের সাবেক সচিবালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে সময় কাটছিল পুলিশ অফিসারদের। রাজ্য প্রশাসনের কন্ট্রোলরুম গঙ্গা পেরোনোর পর থেকে শতাব্দীপ্রাচীন লালবাড়ির ডিউটিতে আগের মতো ব্যস্ততা নেই তাঁদের। চলছিল টুকটাক গল্প।

আচমকা তিনি এলেন ‘ভিআইপি’।

Advertisement

ঘড়ি বলছে, দুপুর ১টা। গেটের সামনে পুরনো মেজাজে তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই আইনরক্ষকদের চোখ কপালে। পারলে নিজেদের গায়ে চিমটি কেটে দেখেন, ‘এ কি সত্য সকলই সত্য!’

পুলিশের ওয়্যারলেস থেকে তখন ছিটকে ছিটকে আসছে ধাতব স্বর “ভিআইপি ইন রাইটার্স.... ভিআইপি ইন রাইটার্স”।

গাড়ি থেকে নেমে গটগট করে হেঁটে সোজা লিফ্টে উঠে গেলেন ‘ভিআইপি’। যাওয়ার আগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাদা উর্দিদের প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “কী, কাজ হচ্ছে তো?”

দোতলায় ভিআইপি-র পিছনে পিছনে তখন ছুটছেন তাঁর দেহরক্ষীরা। ছোট-বড় সরকারি কর্তারা এ-কোণ, সে কোণ থেকে দৌড়ে আসছেন। সম্বিত ফিরে পেয়েও পুলিশের তখন মাথা খারাপ হওয়ার দশা।

‘ভিআইপি’ হেঁটে চলেছেন তাঁর বিখ্যাত ভঙ্গিমায়। চটি ফটফটিয়ে সদাব্যস্ত তিনি। ডাইনে-বাঁয়ে কতটা কী দেখছিলেন, বোঝা গেল না। তিনি বোঝার সময় দিলেন না। মহাকরণে তাঁর পুরনো ঘরের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুখ্যসচিবের ঘর পর্যন্ত গেলেন। তার পর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে উঠে গেলেন গাড়িতে। এত ক্ষণে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সকলের।

পূর্ত দফতর-সহ মহাকরণে সেই সময়ে কর্তব্যরত কয়েক জন অফিসার তখনও হন্তদন্ত হয়ে আসছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে ‘ভিআইপি’-র গাড়ি রাজভবনের রাস্তা ধরে নিয়েছে। পুরনো কর্মস্থল থেকেই রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন তিনি।

বিনয়-বাদল-দীনেশের স্মৃতিধন্য ইমারতে তখন বইছে কৌতূহলের স্রোত। কেন এই দশ মিনিটের ঝড়? কী দেখলেন ‘ভিআইপি’? কেন এলেন, কেন গেলেন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ দিন কালীঘাটের বাড়ি থেকে সোজা নবান্নে যাওয়ারই কথা ছিল ‘ভিআইপি’-র। প্রশাসনিক কাজ ও গুটিকয়েক বৈঠক ছাড়া বৎসরান্তে অন্য কোনও কর্মসূচি ছিল না। নবান্নের পুলিশকর্মীরা তাঁরই অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎই মহাকরণের দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলেন ‘ভিআইপি’।

ঝাঁ চকচকে বহুতলে সংসার সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বলেছিলেন, পুরনো কর্মস্থলের বাড়িটির আগাগোড়া সংস্কার করতে চান। তবে কি সেই সংস্কারের হাল-হকিকত জানতেই এ দিনের ঝটিকা সফর? নাম প্রকাশে ‘অপারগ’ কয়েকটি সূত্র তেমন দাবি করলেও কেউ কেউ আবার সত্যান্বেষীর মেজাজে। তাঁদের সন্দেহ, তল্পিতল্পা গুটিয়ে এ বার হয়তো লালবাড়িতেই ফিরতে চাইছেন ‘ভিআইপি’! এবং হয়তো সেই কারণেই ভরদুপুরের এই ঝোড়ো ‘রেকি’। কটাক্ষে কেউ কেউ জুড়ে দিচ্ছেন, ‘নীল-সাদা নবান্নে যাওয়া ইস্তক অস্বস্তি যে পিছুই ছাড়়ছে না! অগত্যা লালবাড়ি...।’ পূর্ত দফতরের কর্তারা অবশ্য সে সব রসিকতায় আমল দিচ্ছেন না। বলছেন, এমন কোনও খবর তাঁদের কাছে নেই।

তবে যে সংস্কার নিয়ে এত কথা, তার কী হাল?

এক কথায়, তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু নয়! এক কর্তা জানালেন, আসল কাজটাই এখনও শুরু হয়নি। সবেমাত্র সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে কাঠ ও প্লাইউডের অস্থায়ী ঘরগুলো ভাঙা হয়েছে। বাম জমানায় বিভিন্ন দফতরকে জায়গা দিতে মহাকরণের অন্দরে বাড়তি কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল। সেগুলো এ বার ভেঙে ফেলার কথা। কিন্তু সে কাজ এখনও হয়নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি কমিটি কিছু দিন আগে রিপোর্ট দিয়েছে বর্তমান সরকার বাহাদুরকে। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে সরকার নিজের মত জানাবে। অভিজ্ঞ সংস্থা বাছাই হবে। তার পর মহাকরণ সংস্কারের ‘আসল কাজ’ শুরু। সেই কাজ শেষ হতে হতে অন্তত বছর দুয়েক। অর্থাৎ আগামী বিধানসভা ভোটের আগে তো নয়-ই!

ক’দিন আগে মন্ত্রী-সান্ত্রিদের কার্যত অন্ধকারে রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গে। একই ভাবে এ দিন ডালহৌসি পাড়ায় তাঁর আগমনের পূর্বাভাস ছিল না কারও কাছে। কেন বারবার এমন ঝড় তুলছেন ‘ভিআইপি’?

নিরাপত্তার খাতিরে ওয়্যারলেস-বার্তায় মুখ্যমন্ত্রীর নাম বা পদ উচ্চারণ করে না রাজ্যের গোয়েন্দা-পুলিশ। বলে ‘ভিআইপি’!

৩১ ডিসেম্বরের দুপুরে অবশ্য শেষমেশ সব অঙ্কই গুলিয়ে যায়। ম্যানপ্যাক থেকে শুধু ভেসে আসতে থাকে, “ভিআইপি ইন রাইটার্স”!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement