দিদি বলেছিলেন, কড়া প্রতিবাদ হবে। দিদির মেজাজ গরম দেখে তাঁর দামাল ভাইয়েরা আর অপেক্ষা করেননি। পরপর দু’দিন রেল-সড়ক অবরোধ করে, গাড়িঘোড়া আটকে দিয়ে তাঁরা তুমুল প্রতিবাদের চিহ্ন রেখেছেন। প্রতিবাদের আবেগে তাঁরা খেয়ালই করেননি, অবরোধের ধাক্কায় তাঁরা আসলে মুখ পোড়াচ্ছেন দিদিরই! ক্ষুব্ধ দিদি এ বার দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ওদের থামতে বলুন!
এ আসলে পথের ধাঁধা! পথে নামলে বিপদ। আবার না নামলেও! কোন পথে চলবে, ভেবে পাচ্ছে না তৃণমূল। মদন-কাণ্ডে তাদের সামনে এখন উভয় সঙ্কট!
মন্ত্রী মদন মিত্রকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাস্তায় না নামলে বার্তা যেত, দল তাঁর পাশে নেই। তার চেয়েও বড় কথা, সারদা-কাণ্ডের দায় মাথায় নিয়ে ফেলা হতো! তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট নির্দেশ, পথে নামতেই হবে! আবার পথে নেমে অবরোধ-বিক্ষোভ করলে আম-জনতার ভোগান্তি। সারদার এই বাজারে সেই ঝুঁকি নেওয়াও যে খুব চাপ! অথচ শনি-রবিবার সেই চাপই নিয়ে ফেলেছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা।
পরপর দু’দিন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অবরোধের জেরে ভোগান্তিতে পড়া সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন, প্রতারণায় অভিযুক্ত হয়ে কেউ গ্রেফতার হলে তাঁরা কেন ‘শাস্তি’ পাবেন? এমনিতেই নানা ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ বাড়ছে। পথে-ঘাটে তার ইঙ্গিতও বিস্তর। এর পরে আজ, সোমবার সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন মদনের জন্য অবরোধে আটকে ক্ষুব্ধ নিত্যযাত্রীরা নিজেরাই অবরোধ তুলে দিতে গেলে শাসক দলের লজ্জার আর শেষ থাকবে না! পরিস্থিতি আঁচ করেই অবরোধ বন্ধ করতে ময়দানে নেমেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
কালীঘাটের বাড়িতে তাঁর রবিবাসরীয় আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী দলের সর্তীর্থদের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেছেন কমর্ীর্-সমর্থকদের একাংশের কাণ্ড-কারখানায়। তাঁর প্রশ্ন, তিনি প্রতিবাদ করতে বলেছিলেন। অবরোধ করতে তো বলেননি! ক্ষমতায় আসার আগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা বন্ধ-অবরোধের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরপর দু’দিনের উল্টো ঘটনায় আম জনতা মমতার সেই ঘোষণা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে! দলনেত্রীর মনোভাব বুঝে নিয়েই জেলায় জেলায় বার্তা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বারবার বলছি, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করুন, বিক্ষোভ-মিছিল করুন। কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে রেল-রাস্তা অবরোধ করবেন না। সাধারণ মানুষকে অসুবিধায় ফেলে অবরোধ কর্মসূচি তৃণমূল নেতৃত্ব অনুমোদন করেন না।”
প্রায় একই কথা শনিবারও বলেছিলেন পার্থবাবু। তার পরেও এ দিন রাজ্য জুড়ে অবরোধের রাস্তায় গিয়েছেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। কোথাও রাস্তায় বসে পড়ে, কোথাও রেললাইন আটকে বিক্ষোভ হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। তৃণমূলের জেলা নেতাদের কেউ বলছেন, পার্থবাবুর নির্দেশ তাঁরা জানতেন না! কারও দাবি, কর্মীরা অবরোধ কর্মসূচি নিয়েছেন, সেটাই জানা ছিল না! ব্যাপার দেখে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, “মদন মিত্র ধরা পড়ায় এত অবরোধ! মুকুল রায় ধরা পড়লে কী করবে? তখন হয়তো দেখব, তেজ কমে গিয়েছে! তৃণমূলের কাজকর্ম তো একটু উল্টো!”
পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরে এ দিন বিকালে তৃণমূলের মিছিল ও পথসভার জেরে যানজট হয়েছিল। সেখানে ছিলেন দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অখিল গিরি। শীর্ষ নেতৃত্বের নিষেধ সত্ত্বেও এমন কর্মসূচি কেন? অখিলবাবুর বক্তব্য, “পার্থবাবুর নির্দেশ আমি জানতাম না। জানলে করতাম না।” বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাঁটিতে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ চলে ঘণ্টাদেড়েক। নেতৃত্বে সাংসদ সৌমিত্র খাঁ, শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউরিও। সাংসদ প্রথমে দাবি করেন, সাধারণ মানুষ অবরোধ করেছিলেন। পরে মেনে নেন, দলের কর্মীরা প্রতিবাদে নেমেছিলেন। বিধায়ক স্বপনবাবু আবার বলছেন, “দলের কোনও নির্দেশ ছিল না ঠিকই। আবেগের বশে অবরোধ করেছি। সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েই পথ আটকেছি।” বাঁকুড়ার সিমলাপালেও রাজ্য সড়ক অবরোধ করে তৃণমূল। জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ অবশ্য বলেন, “অবরোধের নির্দেশ দল দেয়নি। তার পরেও কোথাও অবরোধ হয়েছে কি না, খোঁজ নেব।”
তৃণমূলের অবরোধে বর্ধমানের পানাগড়ে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের দার্জিলিং মোড়ে ঘণ্টাখানেক যানজট হয়। নদিয়ায় বড় জাগুলিয়ায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। কোচবিহারের দেওয়ানহাটে রেল অবরোধ করে শাসক দল। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় ক্যানিং লাইনের তালদি স্টেশনে আধ ঘণ্টা রেল অবরোধ চলে। ট্রেনযাত্রী রিঙ্কি প্রামাণিক, দীপঙ্কর দাসদের ক্ষোভ, “কোথাও কিছু হলেই ট্রেন আটকে দেওয়া হয়। আমাদের কত ক্ষতি হয়, কেউ বোঝে না!” সেই সঙ্গে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, “তৃণমূলের ঘাসফুল নেত্রীর সৌজন্যে এখন বাঁশফুলে পরিণত! লোকে বলে, বাঁশফুল মড়কের বার্তা নিয়ে আসে!”