প্রথমে সারদা-কাণ্ড এবং তার পরে বর্ধমান। জোড়া ধাক্কার ঠেলায় ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে উঠেছে তৃণমূলের অন্দরে!
একের পর এক কেলেঙ্কারিতে শাসক দলের নাম জড়িয়ে প্রভূত বিড়ম্বনার প্রেক্ষিতে এ বার তৃণমূলের সংগঠনের রাশ ফের নিজের হাতে নিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে যে দায়িত্ব পালন তাঁর পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং সেই সুযোগেই সংগঠনে অবিসংবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন মুকুল রায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রীর সিদ্ধান্ত, যাবতীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব এ বার মুকুলের সঙ্গেই ভাগ করে নেবেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত বক্সী। দলনেত্রীর নির্দেশ মোতাবেক, শুক্রবার থেকেই দায়িত্ব পালন শুরুও করে দিয়েছেন পার্থ-সুব্রত জুটি। শাসক দলের অন্দরে যাকে ‘অ-মুকুলায়নে’র প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখা হচ্ছে!
একা মুকুলের হাতে সংগঠনের খুঁটিনাটি ছেড়ে না রাখার পাশাপাশিই তৃণমূল নেত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দলের সব স্তরের নেতাদের নিয়ে সোমবারই তিনি তৃণমূল ভবনে বৈঠক করবেন। দলের মহাসচিব পার্থবাবু এ দিন বলেন, “দলের সব সাংসদ, মন্ত্রী, জেলা সভাপতি ও গণসংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বৈঠকে থাকবেন। দলনেত্রী তাঁদের মুখোমুখি হবেন। তার পরে নভেম্বর থেকে কয়েকটি জেলা সম্মেলনেও দলনেত্রী নিজে যাবেন।” তৃণমূলের অন্দরের ব্যাখ্যায়, এ সবই দলের ভিতরে ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার অঙ্গ। এক নেতার কথায়, “ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর বলতে যা বোঝায়, এটাও তা-ই!” যদিও পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, “বিজয়ার পর দলনেত্রী এমন বৈঠক করেই থাকেন। এতে নতুন কিছু নেই! দলের জেলা সম্মেলনে তিনি আগেও গিয়েছেন।”
প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতৃত্ব যা-ই বলুন, দলের অন্দরের ব্যাখ্যা অবশ্য বৃহত্তর চিত্রনাট্যেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত গতি পাওয়ার পর থেকেই দলে তৃণমূল নেত্রীর আস্থা অনেকটা হারিয়েছেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর বদলে ধীরে ধীরে ‘যুবরাজ’ হিসাবে উত্থান ঘটেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মুকুলের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য যে দু’জনকে বেছে নিয়েছেন মমতা, সেই পার্থ-সুব্রতের সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্ক মুকুলের তুলনায় মসৃণ। স্বভাবতই এঁদের হাতে দায়িত্ব থাকলে তুলনায় স্বচ্ছন্দে থাকবেন অভিষেক, পিসিও তাঁদের উপরে আস্থা রাখতে পারবেন।
কিন্তু এর মধ্যেও অন্য অঙ্ক দেখছে দলের একাংশ। শাসক দলের এক বিধায়কের কথায়, “সংগঠনের আটঘাট সব জানেন মুকুলদা। এক জন একার হাতে যে কাজ নিজের মতো করতে পারেন, সেটাই তিন হাতে করতে গেলে কোথাও কোথাও ঠোকাঠুকি অনিবার্য! তখন সেই সমস্যা দেখিয়েই যুবরাজকে আরও সামনে আনা সহজ হবে।” দলের এই অংশের ব্যাখ্যা, শুষ্কং কাষ্ঠং ব্যবহারের জন্য বক্সী সংগঠনের সব মহলে খুব জনপ্রিয় নন। পার্থবাবুর পক্ষেও মন্ত্রিত্বের গুরুদায়িত্ব সামলে সংগঠনের সব দিক সামলানো কঠিন। এই বাস্তব সমস্যা থেকেই দল পরিচালনায় কিছু জটিলতা দেখা দেবে। যা আসলে পথ প্রশস্ত করবে ‘ভাইপো লাও, পার্টি বাঁচাও’ স্লোগানের!
যুবরাজের জন্য ঘুঁটি সাজানোর প্রক্রিয়া এমনিতেই অব্যাহত। দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্না কর্মসূচি নিয়ে চূড়ান্ত নাটকীয়তার মধ্যেই যেমন ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটেই চলেছে! এখন আবার ঠিক হয়েছে, তৃণমূল নয়, ১৬ অক্টোবরের কর্মসূচি হবে তৃণমূল ‘যুবা’র ব্যানারেই। যার সর্বভারতীয় সভাপতি স্বয়ং অভিষেক। প্রথম পরিকল্পনার সময় ‘যুবা’র হাতেই এই কর্মসূচি ছাড়তে চেয়েছিলেন মমতা। দলেই তা নিয়ে আপত্তির জেরে প্রতিবাদ-সভা বদলে নেওয়া হয়েছিল সরাসরি তৃণমূলের নামেই। সেই অনুযায়ী ঘোষণাও হয়েছিল। এখন আবার তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘যুবা’কেই! দলের মধ্যে একাংশের বক্তব্য, সাংসদদের কাউকে কাউকে দিয়ে ‘যুবা’র দিল্লি চলো নিয়ে আপত্তি তোলানোর নেপথ্যে ছিলেন মুকুলই। সেটা বুঝেই পুরনো পরিকল্পনায় ফিরে গিয়েছেন মমতা। যদিও মুকুল-পন্থীদের পাল্টা বক্তব্য, “সবই দলনেত্রীর ইচ্ছা! সিদ্ধান্ত তাঁরই। এখানে দাদার নাম অহেতুক জড়ানো হচ্ছে।”
মুকুল বা বক্সী কেউই এ দিন এই নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে তৃণমূল সূত্রের খবর, দিল্লির কর্মসূচিতে সাংসদদের উপস্থিতির উপরেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। মহাসচিব পার্থবাবু অভিষেককে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে কাজ ছেড়ে তাঁর পক্ষে এখন দিল্লিতে ওই কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়া সম্ভব নয়। চেষ্টা চলছে, বক্সী-মুকুলকে (দু’জনেই সাংসদ) যন্তর মন্তরে হাজির করিয়ে সভায় যথোচিত গাম্ভীর্য আনার।
প্রশ্ন উঠছে, তৃণমূলে সংগঠনের চাবিকাঠি যে মুকুলের হাতে, সেই তথ্য তো হঠাৎ আবিষ্কৃত নয়! দলনেত্রীর বরাভয় নিয়েই মুকুল সংগঠনের জাল বিছিয়েছেন। তা হলে হঠাৎ এখন তৃণমূল নেত্রীর এমন তৎপরতা কেন? দলের একাংশ বলছে, সারদা-কাণ্ডে মুকুল এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজনের জড়িয়ে পড়া থেকেই এর শুরু। বর্ধমান-কাণ্ডে সন্ত্রাসবাদী তথা মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে স্থানীয় স্তরে শাসক দলের নেতাদের যোগসাজশের অভিযোগ ক্রমশ প্রকট হতে শুরু হওয়ার পরে আর ঝুঁকি নিতে চাননি তৃণমূল নেত্রী। দলের এক নেতার কথায়, “গত তিন বছরে মুকুল কোথায় কার কার হাতে তৃণমূলের ঝান্ডা ধরিয়েছেন, কেউ খতিয়ে দেখেনি! এখন একের পর এক ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, সর্বনাশটা কোথায় হয়ে রয়েছে!”
বোঝা অবশ্য এখনও পুরোপুরি যাচ্ছে না! দলেরই এক সাংসদের কথায়, “জেলার কোনও শহরের কোথায় তৃণমূলের কার্যালয় হয়েছে, কার কাছে তার চাবি থাকে, সব মুকুল জানেন। দেখব বললেই যে কারও পক্ষে দল দেখা এখন কঠিন!” এই সত্য বুঝেই মুকুলকেও সঙ্গে রেখে পার্থ-বক্সীকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। তৃণমূল ভবনে এ দিনই দু’জনে দু’টি জেলার নেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকের পরেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন মুকুল। তখন তাঁকে নিয়েই ত্রয়ীর আলোচনা হয়েছে।
দলের এক বর্ষীয়ান নেতার মন্তব্য, “আমাদের দল স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। কাউকে এড়িয়ে, কাউকে লুকিয়ে করার কিছু নেই। মুকুল তো ছিল। আজও ওকে নিয়েই আলোচনা যা হওয়ার হয়েছে!”