বিজেপির সভায় উপচে পড়েছে ভিড়। বর্ধমানের বড়নীলপুরের মাঠে। মঙ্গলবার উদিত সিংহের তোলা ছবি।
আশপাশের কোনও বাড়ির ছাদে তিলধারণের জায়গা নেই।
সামান্য দূরে জিটি রোড বাইপাসে হাজার-হাজার মানুষ। ভিড় ঠেলে গাড়ি পার করাতে হিমশিম হচ্ছে পুলিশ।
একটু দেরিতে পৌঁছনোয় সভার মাঠে জায়গা পেলেন না যাঁরা, ছুটলেন পাশের ছোট মাঠে। খানিক পরে সেখানেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তখনও মঞ্চে ওঠেননি। কিন্তু যত দূর চোখ যায়, শুধু মাথার সারি। মঙ্গলবার দুপুরে যা দেখে দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক তথা রাজ্যের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বললেন, “বর্ধমানের মাটিকে আমার প্রণাম!”
এ দিনই শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে লোক না দেখে ড্রেসিংরুমে ঢুকে বসে পড়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী মঞ্চের সামনেও চেয়ার ফাঁকা পড়ে ছিল। তাঁর ভাইপো অভিযেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে আজ, বুধবার আবার বর্ধমানে একই মাঠে বিজেপির পাল্টা সভার ডাক দিয়েছে তৃণমূল।
কত লোক হয়েছিল অমিত শাহের সভায়? বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়ের দাবি, “অন্তত এক লক্ষ লোক হয়েছে। পুলিশকে জিজ্ঞেস করুন। ওরা যা বলবে, তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিলেই বোঝা যাবে, আসলে কত মানুষ এসেছেন।” দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “সভার পরে তৃণমূল বুঝে যাবে, রাজ্যে বিজেপি বসে গিয়েছে। কোনও মতে আর তাদের সরানো যাবে না।”
পুলিশের মতে, বড়নীলপুরের ওই মাঠে হাজার বিশেকের বেশি লোক ধরে না। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “মাঠটি আকারে ছোট। বিশ-বাইশ হাজার লোক এসেছিলেন, এটুকু বলা যায়।” আর যাঁরা মাঠের বাইরে ছিলেন? রাস্তায়, ছাদে, পাশের মাঠে ছড়িয়ে ছিলেন যে অগণিত মানুষ? পুলিশ তার হিসেব দিতে পারেনি। তবে এই ভিড় যে বিজেপি নেতাদের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিজেপি আগেই জানিয়েছিল, দক্ষিণবঙ্গের জেলা থেকে কর্মী-সমর্থকেরা আসবেন। বর্ধমানের বাইরে মূলত বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া ও হুগলি থেকে মানুষজন এসেছেন। বাস, গাড়ি, মোটরবাইকে করে লোক আসতে দেখা গিয়েছে। ট্রেনেও আসেন অনেকে। দূরদূরান্ত থেকে আসা কর্মীদের সকাল-সকাল বেরোতে হয়েছে। সভাস্থলে পৌঁছেই তাই অনেকে দৌড়ন পাশের মাঠে অস্থায়ী ডিম-পাঁউরুটি-রোল-ঘুগনির দোকানে।
তবে ১টার পরে হুড়মুড় করে মাঠে লোক ঢুকতে শুরু করে। অনেকে বাঁশের ব্যারিকেড টপকে মঞ্চের সামনে ফাঁকা অংশে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। তাঁদের ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যায় পুলিশ। সেই বর্ধমানে, যেখানে চার বছর আগেও বাম ছাড়া কিছু কার্যত ছিল না। কিন্তু সরকার পাল্টাতেই তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে জেলার রাশ তৃণমূলের হাতে যায়।
সভায় ভিড় দেখে মাঠে জল্পনা শুরু হয়ে যায়, তবে কি রাজ্যের অন্যতম সম্পন্ন জেলা এ বার নরেন্দ্র মোদীর দলের দিকে ঝুঁকছে? বাঁকুড়ার জয়রামবাটী থেকে আসা বিজেপি কর্মী বিপুল কর বলেন, “ক্ষমতায় আসার ঠিক আগে মমতার সভায় এমন ভিড় হত। এখন আমাদের সভায় হচ্ছে!” আশপাশ থেকে ‘ঠিক, ঠিক’ বলে সায় দেন অনেকেই।
বর্ধমানের নানা এলাকা, এমনকী আশপাশের জেলাতেও কয়েক দিন আগে থেকে সভায় না আসার জন্য বিজেপি কর্মীদের হুমকি ও মারধরের অভিযোগ উঠছিল। সভা শুরুর আগে বিজেপি নেতারা অভিযোগ করেন, বর্ধমানের বাজেপ্রতাপপুরের কাছে তাঁদের ৭০-৮০টি গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের কাছে এ ব্যাপারে ব্যবস্থার আর্জিও জানানো হয়। তবে পুলিশের দাবি, সে রকম কিছু ঘটেনি।
বিজেপি রাজ্য সভাপতি অভিযোগ করেন, অমিত শাহের জন্য পুলিশ পাইলট কার রাখেনি। তবে এসপি-র দাবি, “সোমবার আমাদের সঙ্গে সিআরপি-র বৈঠক হয়। তাতে ওরা লিখিত ভাবে জানায়, অমিত শাহের গাড়ির সামনে পাইলট কার ওরাই রাখবে। আমরা শক্তিগড়ের কাছে বর্ধমান থানার একটি আরটি ভ্যান রেখেছিলাম। সিআরপি সরিয়ে দেয়।”
বিজেপির সভার ভিড় মাঠ ছাপিয়ে আশপাশের এলাকা অচল করে দিলেও তৃণমূল নেতারা এতে কোনও সাফল্য দেখছেন না। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিজেপি নেতারা ২০১৬-য় রাজ্যে ক্ষমতায় আসার দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এত ঢাকঢোল পিটিয়েও সভা ফ্লপ করেছে বলে অমিতবাবুর গোসা হয়েছে। তাই পাঁচ-ছ’মিনিটের মধ্যে বক্তৃতা শেষ করেছেন।” পার্থবাবুর দাবি, বহু টাকা খরচ করে, কোথাও ভয় দেখিয়ে লোক জোগাড়ের চেষ্টা করেও বিজেপি বিশেষ ভিড় জমাতে পারেনি। নভেম্বরে ধর্মতলায় অমিত শাহের সভার কথা তুলে তাঁর দাবি, “সে দিন যে তাপ-উত্তাপ ছিল, সেই বেলুন চুপসে গিয়েছে। ওঁরা বুঝেছেন, বাংলায় পদ্ম ফোটানো সহজ নয়।”
সভার প্রস্তুতির দৌড়দৌড়িতে সোমবার মাঠেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন বিজেপির বর্ধমান জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি দেবীপ্রসাদ মল্লিক। এ দিন ভিড় দেখে তাঁর মুখে চওড়া হাসি। হাসতে-হাসতে বললেন, “এত চেষ্টা তো করল ওরা। লোক আসা কি ঠেকাতে পারল?”