শহিদ মিনার ময়দানে ভিডিও বার্তা অসুস্থ গৌতম দেবের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
ভয় যত ভাঙছে, ভিড়ও তত বাড়ছে!
সারদা-সহ নানা কাণ্ডে যত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, ধীরে ধীরে জমি ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় গতি আনছে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। গত এক মাসের মধ্যে খাস কলকাতায় তাদের একের পর এক কর্মসূচিতে ভিড় বাড়ছিল। সেই তালিকায় এ বার উপরে উঠে এল মঙ্গলবারের শহিদ মিনার ময়দান!
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সমাবেশ উপলক্ষে এ দিন আক্ষরিক অর্থেই বামেদের দখলে চলে গিয়েছিল ময়দান। সমাবেশের মাঠে লোক তো বটেই, আশেপাশে উত্তর ও দক্ষিণমুখী সব রাস্তাতেই কয়েক ঘণ্টার জন্য থিকথিক করছিল সিপিএম সমর্থকদের ভিড়। শুধু একটি জেলার সমাবেশে আসা জনতার জন্য উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে হরিয়ানা ভবন ছাপিয়ে গিয়েছিল বাস-লরির লাইন, দক্ষিণে মেয়ো রোড ও পশ্চিমে বাবুঘাট পর্যন্ত ময়দান চত্বরেও একই ছবি। সিপিএমের হিসেব, জেলা থেকে লোক এনেছে ১,৬৮৭টি বাস-লরি!
রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরেও বড় ব্রিগেড সমাবেশ করে দেখিয়েছে বামেরা। কিন্তু অতীতে বারেবারেই লোক আনার গাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। এখন উপুর্যপরি তাদের মিছিল-সমাবেশে গাড়িঘোড়া আসছে কী ভাবে? সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “ভয় এখন ভাঙছে বলেই এটা হচ্ছে। আগে গাড়ি ভাড়া করার জন্য আগাম টাকা দিলেও মালিকেরা এসে অ্যাডভান্স ফেরত দিয়ে যেতেন। এখন তাঁরা গাড়ি দিতে রাজি হচ্ছেন।” পারিপার্শ্বিক দেখে জড়তা কাটছে সিপিএমেরও। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এই সমাবেশ উপলক্ষেই যেমন তারা পাড়ায় পাড়ায় ভরা বাজারে পথসভা করেছে। তাতে লোকের সাড়া মিলেছে, চাঁদাও জমা পড়েছে। যে ঘটনা গত সাড়ে তিন বছরে তেমন ভাবে ঘটছিল না।
ভয় ভাঙার ইঙ্গিত পেয়েই এ দিনের সমাবেশ থেকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং জেলা সম্পাদক গৌতম দেব সংগঠনের জড়তা কাটিয়ে আরও তৎপরতা বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন। এবং আক্রমণের নিশানা হিসাবে বেছে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকেই। বিমানবাবু বলেছেন, “সংগঠনের কিছু আড়ষ্টতা, জড়তা ছিল। নিষ্ক্রিয়তাকে কাটিয়ে আপনাদের পথে নামতে হবে। ব্লকে ব্লকে, মহকুমায় মহকুমায় রাস্তায় নেমে নিজেদের কথা বলতে হবে।” বিজেপি এবং তৃণমূল হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভোট মেরুকরণের চেষ্টা করছে বলে জানিয়ে ভিডিও-বার্তায় গৌতমবাবুর আহ্বান, “নিজেদের উপরে ভরসা রেখে আগামী পুরভোট থেকেই আমাদের নতুন করে পুনরুদ্ধার করতে হবে।” আর সূর্যবাবু ডাক দিয়েছেন, “এটা শুধু একটা জেলার সমাবেশ হল। আগামী মার্চে গোটা রাজ্যের সমাবেশ হবে ব্রিগেড ময়দানে। ভিড়ের নতুন রেকর্ড আমরা সেখানে গড়ব! চ্যালেঞ্জ থাকল, বিজেপি তাদের সর্বভারতীয় সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে এনে এমন সমাবেশ করে দেখাক।” পাশাপাশিই মমতার প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “আপনাকে আর কী বলব? আপনি আগে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচে লোক ভরিয়ে দেখান!” বক্তা তালিকায় নাম না থাকলেও শারীরিক অসুস্থতা এবং মাঠে প্রবল ধুলোর মধ্যে আর বক্তৃতা করেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সমাবেশের গোড়ায় এক বার ময়দান ঘুরে ফিরে গিয়েছেন তিনি।
বামেদের কর্মসূচিতে ফের ভিড় শেষ পর্যন্ত ভোটের বাক্স অবধি যাবে কি না, তার উত্তর সময় দেবে। কিন্তু সাধারণ পাটিগণিতের ধারণা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট বামেরা ধরে রাখতে পারলে বিজেপি-র ২০১৬-য় তৃণমূলকে উৎখাতের স্বপ্ন ধাক্কা খাবে। যে আশঙ্কা থেকেই সিপিএমের জমায়েতকে আক্রমণ করে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন দাবি করেছেন, “এ সব করে কোনও লাভ হবে না! মানুষ সিপিএমকে বিশ্বাস করে না। তৃণমূলের নির্দেশে ওরা পথে নেমেছে!”
প্রত্যাশিত ভাবেই এমন দাবি উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল এবং সিপিএম, দু’দলই। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “বামেদের সমাবেশে কেমন ভিড় হয়েছিল, আমি জানি না। ওঁরা এখন নানা ভাবে বাজার গরম করার চেষ্টা করছেন!” তবে শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতার ব্যাখ্যা, “সিপিএমের ডাকে ভিড় হয়ে থাকলে সেটা আসলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জেহাদের ফসল হিসাবে দেখতে হবে। বিজেপি বরং এটা ভাল করে দেখুক!”
‘নবান্ন অভিযানে’র কর্মসূচি থাকলেও প্রত্যাশিত ভাবেই ডাফরিন রোডে সিপিএমের মিছিল আটকে দিয়েছিল বিরাট পুলিশ বাহিনী। সরকার এবং পুলিশ-বিরোধী স্লোগান দিয়েই সেখানে প্রায় আধঘণ্টা রাস্তায় বসে ছিলেন সিপিএম সমর্থকেরা। পুলিশের ব্যারিকেড ছিল চারটি বলয়ে! আবার যে নবান্নে মিছিল যায়ইনি, সেখানেও দিনভর সাজ সাজ রব পুলিশের! প্রাক্তন সাংসদ তড়িৎ তোপদারের নেতৃত্বে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের ৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল বিধানসভায় গিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে দাবিপত্র জমা দিয়ে ফিরে আসে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “এখানে যা লোক ছিল, চাইলে সহজেই ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম সরকারকে দেখাতে যে, আমরা চাইলে ভাঙতে পারি। কিন্তু ভাঙছি না!”