ভাষায় বেলাগাম দিশাহীন দিদি

বলা কথা আর ছোড়া তির ফিরিয়ে নেওয়া যায় না! শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের কর্মিসভায় বিজেপি নেতাদের আক্রমণ করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “কে তুমি? শালা নাম জানে না কেউ।” পর ক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন বটে, “দুঃখিত, আমি শব্দটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।” কিন্তু তত ক্ষণে বার্তা যা যাওয়ার চলে গিয়েছে। ইন্ডোরে উপস্থিত কয়েক হাজার তৃণমূল কর্মী বুঝে গিয়েছেন সারদা কেলেঙ্কারি থেকে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ একের পর এক ঘটনায় তাঁদের নেত্রী কতটা চাপে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share:

উত্তেজিত মমতা। শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূলের কর্মিসভায় প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

বলা কথা আর ছোড়া তির ফিরিয়ে নেওয়া যায় না!

Advertisement

শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের কর্মিসভায় বিজেপি নেতাদের আক্রমণ করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “কে তুমি? শালা নাম জানে না কেউ।” পর ক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন বটে, “দুঃখিত, আমি শব্দটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।” কিন্তু তত ক্ষণে বার্তা যা যাওয়ার চলে গিয়েছে। ইন্ডোরে উপস্থিত কয়েক হাজার তৃণমূল কর্মী বুঝে গিয়েছেন সারদা কেলেঙ্কারি থেকে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ একের পর এক ঘটনায় তাঁদের নেত্রী কতটা চাপে। কতটা দিশাহারা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারের দৌলতে সে কথা জেনে গিয়েছেন লক্ষ লক্ষ রাজ্যবাসীও।

শুক্রবারই সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল সাংসদ এবং দলের মুখপত্রের সম্পাদক সৃঞ্জয় বসু ওরফে টুম্পাইকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তাদের তলব পেয়েছেন মন্ত্রী মদন মিত্রও। এই জোড়া ধাক্কা যে মমতাকে কার্যত এলোমেলো করে দিয়েছে, তার নজির এ দিনের সভায় একাধিক বার মিলেছে। কেন সিবিআই টুম্পাইকে গ্রেফতার করেছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বলেছেন, তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর আমন্ত্রণে নেহরুর ১২৫তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন বলেই বিজেপি সরকার তাঁকে ‘বাঁশ দিচ্ছে’। তৃণমূল নেতাদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, টুম্পাইয়ের পরে কে, সেই প্রশ্ন প্রতিনিয়ত চিন্তায় রেখেছে মমতাকে। এ দিন কর্মিসভায় তাঁর দিশাহীন বক্তব্য সেই উদ্বেগেরই বহিঃপ্রকাশ।

Advertisement

বস্তুত, বিজেপি, না সিবিআই, না সংবাদমাধ্যম কাকে যে শত্রু করবেন, তাই এ দিন ঠিক করে উঠতে পারেননি মমতা। এক বার দুষেছেন বিজেপি-কে। পর ক্ষণেই খড়্গহস্ত হয়েছেন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে। “সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, একাংশের কাছ থেকে তা পাইনি” বলার পরেই মুন্ডপাত করেছেন বিজেপি এবং সিবিআইয়ের। এ প্রসঙ্গে খানিক সময় কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছেন সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণে। তাদের শত্রুপক্ষ আখ্যা দিয়ে বয়কটের ফতোয়া জারি করেছেন। এমনকী সেই ফতোয়া মান্য করার দিব্যি আদায় করে নিয়েছেন উপস্থিত নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে।

তার পরেই আবার সিবিআই-কে দুষে বলেছেন, ওরা প্রতারকের বিরুদ্ধে কিছু করছে না। উল্টে প্রতারককে যারা প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ, তাদের ধরতে ব্যস্ত। আবার সংবাদমাধ্যমকে দুষে সারদার বিজ্ঞাপন নেওয়া সব কাগজের সম্পাদককে ধরার দাবি তুলেছেন।

সঙ্গে সঙ্গেই অভিযোগ করেছেন, “খাগড়াগড়ে হয়তো কেন্দ্রই ‘র’-কে (বিদেশে গোয়েন্দাগিরি জন্য গঠিত সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) দিয়ে বোমা রাখিয়েছে। মনে রাখবেন, আমি ২৩ বছর কেন্দ্রে ছিলাম। কে, কী ভাবে ষড়যন্ত্র করে, সব জানি।” কাল, সোমবার বিকেল তিনটেয় কেন্দ্রের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলেরও ডাক দিয়েছেন মমতা। কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন তিনি নিজেই।

সভার পরে দলীয় সাংসদদের নিয়ে বৈঠকে মমতা জানিয়েছেন, তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের গ্রেফতার করলে দল তাঁদের পাশে থেকে আন্দোলন করবে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে আশঙ্কা তৃণমূলের অন্দরেই।

সিবিআইয়ের গ্রেফতারি এবং বিজেপি নেতাদের তুমুল সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে মমতা এ দিন বলেন, “বাইরে থেকে এসে কে এক জন বলে গেল, এ চোর, বি চোর, সি চোর, ডি চোর...! আর তুমি সাধু!” এই নেতা সম্পর্কেই অশালীন শব্দ উচ্চারণ করেন মমতা। কোন বিজেপি নেতার উদ্দেশে মমতা এমন মন্তব্য করলেন, তা নিয়ে ফিসফিসানি শুরু হয়ে যায় ইন্ডোরে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কেউ বলেন, “ওটা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহকে লক্ষ করে বলেছেন মমতা।” কেউ আবার বলেছেন, “না, না, ওটা রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে বলেছেন। রাজ্যে এসে উনিই আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কুৎসা করেন।”

মমতার আক্রমণের লক্ষ্য তিনি হতে পারেন জেনে সিদ্ধার্থনাথের পাল্টা মন্তব্য, “আমি সারদা কেলেঙ্কারি এবং খাগড়াগড় বিস্ফোরণ নিয়ে ১০টি করে প্রশ্ন মুখ্যমন্ত্রীকে করেছি। আমাকে বা বিজেপি নেতৃত্বকে আক্রমণ করে উনি সেই প্রশ্নগুলি থেকে অব্যাহতি পাবেন না। জবাব ওঁকে দিতেই হবে।”

সারদা কেলেঙ্কারির ফাঁস যে ক্রমশ তাঁর উপরে চেপে বসছে, সেটা মমতা ক্রমশ বুঝতে পারছেন বলে মনে করছেন শাসক দলেরই একটা বড় অংশ। এক তৃণমূল নেতার কথায়, “আমাদের নেত্রীর আশঙ্কা, তাঁর হাল তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার মতো হতে পারে!” বস্তুত, মমতা নিজেই এ দিন ইন্ডোরে জয়ললিতা প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, “বিজেপি সরকারের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। সনিয়া গাঁধী নয়। এমনকী, জয়ললিতাকে জেলে পুরে রাখলেও ওঁর দলের লোকেরা কিছু বলতে পারে না।” মমতার অভিযোগ, তামিলনাড়ুতে ৩৫৫ ধারা জারি করেছে কেন্দ্র। তাঁর চ্যালেঞ্জ, “আমাদের এখানে ৩৫৬ জারি করে দেখুক, লড়াই করে যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়ে দেব।” পাশাপাশি, কলকাতায় মিছিলের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সেই মিছিলের প্লাকার্ডে থাকবে, কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষায়, আমরা সবাই চোর। কত বড় জেল আছে? তৈরি রাখুন। আমি জেলে যেতে ভয় পাই না।”

রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যালঘু বলেই সেখানে তৃণমূল সাংসদদের গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মমতা। ঘটনাচক্রে সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের দুই সাংসদই রাজ্যসভার। কিন্তু কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করেছিল মমতারই পুলিশ। মমতার এই মন্তব্য শুনে তৃণমূলের এক নেতার প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী কি তবে রাজ্যসভার আরও সাংসদ গ্রেফতার হবেন বলে ভায় পাচ্ছেন?

মমতার অভিযোগ, তিনি সনিয়ার ডাকে দিল্লি গিয়েছিলেন বলেই, তাঁর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁর কথায়, “ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট ডাকলে আমি এক বার কেন, হাজার বার কেন, কোটি বার দিল্লি যাব।” কিন্তু বিরোধীরা মনে করাচ্ছেন, দিল্লি গিয়ে সনিয়ার সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগই পাননি মমতা। বরং বৈঠক করেছেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহের সঙ্গেই।

এ দিন মমতা এক বার সিবিআই তৎপরতার জন্য বিজেপির প্রতিহিংসাকে দায়ী করেছেন, পরে আবার বলেছেন, কংগ্রেস আর বিজেপি মিলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যা শুনে বিরোধী নেতারা বলছেন, উদ্ভ্রান্ত মুখ্যমন্ত্রীর সব কিছুই যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। কোনও যুক্তিই কাজ করছে না। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য আবার মনে করাচ্ছেন, “যে দলের আমন্ত্রণে তিনি নেহরুর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দেন, সেই দলের নেতাই তো সারদা কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন!” প্রসঙ্গত, সারদা নিয়ে মামলাটি করেছিলেন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও বক্তব্য, মমতা নেহরুর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চলছে এবং সৃঞ্জয় বসুর নামও আগেই উঠে এসেছে। তৃণমূলের একের পর এক নেতা-সাংসদ সিবিআই জালে জড়িয়ে যাওয়ায় দলের ভবিষ্যৎ সঙ্কটাপন্ন। তাই মমতা অজুহাত খুঁজছেন!

৩ মে-র কর্মিসভায় মমতা কেন সারদা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে কুণাল ঘোষ, মদন মিত্র, মুকুল রায়, সৃঞ্জয় বসুদের নাম করেছিলেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিপএম সাধারণ সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “কারা সারদার টাকা নিয়েছে, উনি (মমতা) তা জানতেন, তাই ওই ভাবে নাম বলে ফেলেছিলেন। অপরাধ বিজ্ঞানের নিয়মে যে বিষয়টা চাপা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন, অপরাধীর কাছে সেটাই অতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়ে যায়।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement