বড়মার হাত মমতার মাথায়, জটে মঞ্জুল

মঞ্জুল-কাণ্ডে ঠাকুরবাড়ির ভিতরে-বাইরে জট অব্যাহত! মন্ত্রিত্বের পরে এ বার তৃণমূলের বিধায়ক পদও ছাড়তে চেয়েছেন সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁকে সেই সুযোগ দিতে নারাজ! তাঁরা এখন চাইছেন, দলত্যাগ-বিরোধী আইন প্রয়োগ করে মঞ্জুলের বিধায়ক পদ খারিজ করে দেওয়া হোক। সেই মর্মে শুক্রবার স্পিকারকে চিঠিও দিয়েছে তৃণমূল। যার জেরে মঞ্জুলকে নিয়ে রীতিমতো টানাপড়েন তৈরি হয়েছে বিধানসভায়!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৬
Share:

আশীর্বাদের হাত। বৌমা মমতাবালা ঠাকুরের পাশে বীণাপাণিদেবী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

মঞ্জুল-কাণ্ডে ঠাকুরবাড়ির ভিতরে-বাইরে জট অব্যাহত!

Advertisement

মন্ত্রিত্বের পরে এ বার তৃণমূলের বিধায়ক পদও ছাড়তে চেয়েছেন সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁকে সেই সুযোগ দিতে নারাজ! তাঁরা এখন চাইছেন, দলত্যাগ-বিরোধী আইন প্রয়োগ করে মঞ্জুলের বিধায়ক পদ খারিজ করে দেওয়া হোক। সেই মর্মে শুক্রবার স্পিকারকে চিঠিও দিয়েছে তৃণমূল। যার জেরে মঞ্জুলকে নিয়ে রীতিমতো টানাপড়েন তৈরি হয়েছে বিধানসভায়!

এর মধ্যেই মঞ্জুলের মা বীণাপাণিদেবী (বড়মা) এ দিন ঠাকুরবাড়িতে বসে জানিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। বনগাঁ লোকসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী তথা নিজের বড় বৌমা মমতাবালা ঠাকুরের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদও করেছেন তিনি। বড়মা বলেছেন, “ওর (মঞ্জুল) সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।” ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। সে সব থামলে বড়মা আরও বলেছেন, “ওর (মঞ্জুল) ক্ষমতা আছে তাই বিজেপি-তে ঢুকতেই পারে! আমি কী করতে পারি!”

Advertisement

মঞ্জুল অবশ্য দাবি করেছেন, তৃণমূলই তাঁর মাকে দিয়ে এমন কথা বলিয়ে নিয়েছে! সদ্য প্রাক্তন মন্ত্রীর বক্তব্য, “উনি সকলের বড়মা। তিনি আমারও মা। মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক থাকে না, এমনটা পৃথিবীতে কোনও দিন হয় নাকি!” একই সঙ্গে মঞ্জুলের আরও দাবি, “৯৬ বছর বয়সে ওঁর শরীর ঠিক থাকলেও মাথাটা ঠিক থাকে না। জ্ঞান কিছু সময় থাকে, আবার চলেও যায়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই বয়সে মাথা আর স্বাভাবিক হবে না।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি এবং রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক স্বাভাবিক ভাবেই বড়মার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

তাঁর প্রাক্তন দলের বিরুদ্ধে মঞ্জুল যা-ই অভিযোগ করুন, দলত্যাগের ২৪ ঘণ্টা পরে তিনি অবশ্য বুঝতে পারছেন তৃণমূল এবং বিজেপি দু’দলের চালেই তাঁরা ঈষৎ চাপে পড়েছেন! একে তো মঞ্জুল দল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মমতাবালাকে বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ঠাকুরবাড়ির প্রার্থী এবং তাঁর মাথায় বড়মার আশীর্বাদের হাত, এর প্রভাব মতুয়া সম্প্রদায়ের উপরে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। মমতাবালাও যে কারণে এ দিন বলেছেন, “বড়মার আশীর্বাদ আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে মূল্যবান জিনিস!” তৃণমূল নেত্রী জানতেন, মমতাবালাকে প্রার্থী করলে বিজেপি-ও মতুয়া ভোট ভাঙতে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রার্থী করতে প্রলুব্ধ হতে পারে। সেই পথে তারা মঞ্জুল-পুত্র সুব্রত ঠাকুরকে প্রার্থী করলে বিজেপি-রই একাংশ তাতে বেঁকে বসবে। যে ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলেছে। আবার অন্য কাউকে প্রার্থী করলে মঞ্জুলেরা তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা না করতে পারেন। ফলে, বিজেপি-র সামনে উভয় সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি করে দিতে পেরেছেন তৃণমূল নেত্রী।

আর মঞ্জুল বুঝতে পারছেন, এই গোটা পরিস্থিতির উপরে তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাঁকে বা তাঁর ছেলেকে বিজেপি প্রার্থী না করলেও তাঁদের পক্ষে এখন আর অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। মন্ত্রিত্ব এবং তৃণমূল ছেড়ে এসে পিতা-পুত্রের কেউ টিকিট না পেলে আম ও ছালা, দুই-ই হারানোর আশঙ্কা। প্রসঙ্গত, এ দিনই নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা মঞ্জুলের ছেড়ে-যাওয়া ত্রাণ ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন দফতরহীন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের হাতে। খুশি সাবিত্রী বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে কাজ করতে বলবেন, সেই ভাবেই করব।”

এমতাবস্থায় বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এ দিন ফ্যাক্স-বার্তা পৌঁছেছে গাইঘাটার বিধায়ক মঞ্জুলের। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি তিনি বিধায়ক পদও ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, স্পিকারের সামনে বিধায়ককে সশরীরে হাজির হয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। সেই নিয়মের কথা বলেই মঞ্জুলের ইস্তফার ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিষদীয় মন্ত্রী এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি আবার স্পিকারকে চিঠি দিয়ে আর্জি জানিয়েছেন, মঞ্জুলের বিধায়ক পদ খারিজই করা হোক। ঘটনা হল, মঞ্জুল বৃহস্পতিবার বিজেপি দফতরে গিয়ে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলকে তোপ দাগার পরেও তাঁর বিধায়ক পদ খারিজের জন্য চিঠি দেওয়ার কথা বলেননি শাসক দলের নেতৃত্ব। পার্থবাবুই বরং বলেছিলেন, দলের বিধি মেনে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পরে মঞ্জুল নিজেই বিধায়ক পদ ছেড়ে দিলে ‘নৈতিক’ ভাবে তিনিই এগিয়ে থাকতে পারবেন। সেই বিষয়টি বুঝেই বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনের আগে তৃণমূল সক্রিয় হয়েছে বলে দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা। বিধানসভা সূত্রেরও ইঙ্গিত, শাসক দলের আর্জি মেনে মঞ্জুলের বিধায়ক পদ খারিজের বিষয়েই ভাবনা-চিন্তা করা হচ্ছে।

পার্থবাবুদের তৎপরতার আগে এ দিন দুপুরেই অবশ্য মঞ্জুল-প্রশ্নে দলের বৈঠকে মুখ খুলেছিলেন মমতা। দলের সহকর্মীদের কাছে তাঁর বক্তব্য, মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে পারবারিক লড়াইয়ের জেরেই মঞ্জুল-কাণ্ড ঘটেছে। তবে এই নিয়ে দলকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করার চেষ্টা তিনি মেনে নেবেন না। মঞ্জুল দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ‘ব্ল্যাকমেল’ বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন, তা অবশ্য অনেকেই বোঝেননি। পরে পার্থবাবু স্পিকারকে চিঠির প্রসঙ্গে বলেন, “দৃশ্যতই বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন মঞ্জুল। সংবাদমাধ্যমেও ছবি-সহ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বক্তব্য। সর্বভারতীয় তৃণমূলের মহাসচিব হিসেবে স্পিকারের কাছে আর্জি জানিয়েছি, যিনি আমাদের সদস্য নন, তাঁকে তৃণমূলের সদস্য বলে গণ্য না করতে।” মঞ্জুল যে হেতু স্পিকারের কাছে নিজে আসেননি, তাই তাঁর ফ্যাক্সের বদলে তৃণমূলের চিঠিই গ্রহণ করা উচিত বলে পার্থবাবুর যুক্তি। স্পিকার বিমানবাবুও বলেছেন, “তিনি (মঞ্জুল) একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে গ্রহণযোগ্য কোনও পদত্যগপত্র দেননি।” আর খোদ মঞ্জুলের বক্তব্য, “আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পরবর্তী পদক্ষেপ করব।”

কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, “আমাদের তিন বিধায়কও দৃশ্যত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের বিধায়ক পদ খারিজ করা হয়নি। তখন কি পার্থবাবুদের চোখে ছানি পড়েছিল? এই নির্লজ্জ রাজনীতি মানুষ বেশি দিন মেনে নেবে না!” আর দলত্যাগী মন্ত্রীকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই মঞ্জুলকৃষ্ণের হৃদয়ে দেবত্বের জন্মলাভ হয়েছে? রাজনৈতিক ধান্দাবাজ লোক রাজনৈতিক ফায়দা নিতেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে গিয়েছেন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement