খাতায়-কলমে গত লোকসভা ভোটের তুলনায় এ বার বাহিনীর সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। অথচ ভোটের দিন কার্যত তাদের দেখা মেলেনি! ৩০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় দফার ভোটের শেষে সব বিরোধী দলের তোলা এই অভিযোগটি যে কথার কথা নয়, প্রশাসন-সূত্রেই সে রকম তথ্য মিলছে।
রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশ এবং রাজনৈতিক দলগুলি জানাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়, কত সংখ্যায় মোতায়েন হবে তা ঠিক করার একটি নিয়ম রয়েছে। সাধারণত এক এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অতীতের নির্বাচনে অশান্তির ইতিহাস, কিংবা কোনও একটি দলের অত্যধিক ভোটপ্রাপ্তির নজির ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে সেই মতো বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন জেলা প্রশাসন ও পর্যবেক্ষক। কিন্তু সরকারি রিপোর্টেই স্পষ্ট, রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটে সব ক্ষেত্রে নিয়মটা মানা হয়নি। কী রকম?
বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের রিপোর্ট বলছে, ৩০ এপ্রিলের ভোটের জেলাগুলোয় যে সব এলাকা ‘শান্তিপূর্ণ’ হিসেবে পরিচিত, সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল বেশি। আর গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও যেখানে শাসকদলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালিয়ে ভোট লুঠের অভিযোগ উঠেছিল, সেখানে বাহিনীর উপস্থিতি ছিল নগণ্য। অথচ নিয়ম মানলে উল্টোটাই হওয়া উচিত। বস্তুত শান্তিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অঞ্চলে যদি সমান হারে বাহিনী মোতায়েন হয়, তা হলেও সুষ্ঠু ভোটের সম্ভাবনা ব্যাহত হতে পারে বলে প্রশাসনের একাংশের অভিমত। তাদের মতে, স্পর্শকাতর এলাকায় বাহিনীর সংখ্যা অবশ্যই বেশি থাকতে হবে। যেটা না-থাকাতেই এ বার বাহিনীর সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও তৃণমূলের গড়ে তাদের পদচারণা বিশেষ নজরে আসেনি বলে প্রশাসন ও রাজনীতিকদের এই মহলের দাবি।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বীরভূম। নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, ভোটের দিন এই জেলায় ৯০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। আরও এক কোম্পানি ছিল স্ট্রং রুম প্রহরায়। জেলার মাওবাদী প্রভাবিত ন’টি থানা-অঞ্চলে আকাশপথে টহলদারি চালানোর জন্য তৈরি ছিল বায়ুসেনার হেলিকপ্টার। কিন্তু নিরাপত্তা-আয়োজনের সিংহভাগকেই পাঠানো হয়েছিল ছিল সেই সব জায়গায়, যেখানে গত পঞ্চায়েতেও নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে।
ফলে উপযুক্ত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে স্পর্শকাতর এলাকাগুলি। বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কামরে ইলাহি জানাচ্ছেন, সিউড়ি দু’নম্বর ব্লকের ছ’টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও দুবরাজপুর-খয়রাশোল ব্লকের প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েও সাহাপুর ছাড়া কোথাও তাদের দেখা মেলেনি। তাঁর বিস্ময়, “লোবা-র মতো জায়গাতেও কেন্দ্রীয় জওয়ান ছিল না। দুবরাজপুর বা সিউড়ির পঞ্চায়েতগুলিতেও নয়। ফলে অবাধে ভোট লুঠ করেছে তৃণমূল।” ইলাহির দাবি, লোবার আমুড়ি বুথে কারচুপির অভিযোগ পেয়ে কেন্দ্রীয় জওয়ান গিয়েছিল, তৃণমূলের বাহিনী তাদেরও মেরে তাড়িয়ে দেয়। বোলপুর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম তাঁর কেন্দ্রে ৩৪৮টি বুথে কারচুপির অভিযোগ করেছেন। “লাভপুর, বোলপুর, ইলামবাজার, মঙ্গলকোট, কেতুগ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিলাম। ভোটের দিন দেখলাম, সেখানে লাঠিধারী রাজ্য পুলিশ রয়েছে।” আক্ষেপ রামচন্দ্রবাবুর।
কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের হিসেবও অভিযোগের প্রমাণ দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বীরভুমের ‘শান্তিপূর্ণ’ এলাকা নলহাটিতে ৪৮৪ জন, মুরারইয়ে ৪৭৬, রামপুরহাটে ৩৪৪ জন কেন্দ্রীয় জওয়ান ছিল। অথচ সিউড়িতে পাঠানো হয় সাকুল্যে ২৮০ জনকে। সাঁইথিয়ায় (যেখানে তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম মুণ্ডু কাটার হুমকি দিয়েছিলেন) ২৫৬ জন, খয়রাশোলে ৩৬০ জন, কাঁকরতলা থানা-এলাকায় ২৭২ জন কেন্দ্রীয় জওয়ান পাঠানো হয়। প্রসঙ্গত, বীরভূমে সিআরপিএফ-বিএসএফ-আইটিবিপি ছাড়াও মণিপুর, অসম, সিকিম পুলিশ ও বর্ডারিং হোমগার্ড ভোটের ডিউটিতে ছিল। সন্ত্রাসের এলাকাগুলিতে একটি বড় অংশে ভিন রাজ্যের পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। এ দিকে বিএসএফ, সিআরপি, আইটিবিপি-কে পাঠানো হয় তুলনায় শান্তিপূর্ণ জায়গায়! বীরভূমের পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “অশান্তির জায়গাতেই বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হয়েছে।”
বোলপুরেও এক ছবি। কমিশন-সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত ভোটে যে সব এলাকায় সবচেয়ে বেশি কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল, সেই পাড়ুই থানা-এলাকায় ২৭২ জন, নানুরে ৩৯৬ জন ও লাভপুরে ৩৫২ জন জওয়ান ছিলেন। সর্বাধিক স্পর্শকাতর ইলামবাজারে ছিলেন ২৫৬ জন জওয়ান! অথচ প্রায় স্বাভাবিক বোলপুর থানা-এলাকায় ৩৪০ জন জওয়ানকে কার্যত দিনভর বসিয়ে রাখা হয়।
বাহিনী মোতায়েন নিয়ে হুগলি জেলা প্রশাসন আবার অন্য নিয়ম অনুসরণ করে। কমিশনের খবর, হুগলিতে ৫৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছিল। এবং পুরো ফোর্সকে বিভিন্ন থানায় কার্যত সমানুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হয়। কোনটা স্পর্শকাতর, কোনটা শান্তিপূর্ণ, তার বিচার হয়নি। জেলা পুলিশ-সূত্রের খবর, এই জেলায় ‘সন্ত্রস্ত’ ধনেখালিতে ছিল মাত্র তিন কোম্পানি ফোর্স। ‘শান্তিপূর্ণ’ শ্রীরামপুর বা উত্তরপাড়াতেও দু’কোম্পানি করে (প্রায় ৭২ জন)। স্পর্শকাতর এলাকা না-বেছে কেন এ ভাবে বাহিনী ভাগ? জেলা পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “ওই ফোর্স দিয়ে ২৩টি থানা এলাকায় গড়ে দু’-তিন কোম্পানির বেশি দেওয়া সম্ভব ছিল না। শুধুমাত্র আরামবাগে একটা থানায় চার কোম্পানি ফোর্স ছিল।” কিন্তু শান্তিতে ভোট করতে হলে ‘গড়ের অঙ্ক’ কি কার্যকরী হয়? কর্তাটির কাছে এর ব্যাখ্যা মেলেনি। উল্টে তাঁর প্রশ্ন, “ভোটের দিন ধনেখালিতেই পর্যবেক্ষক সারা দিন ঘুরে বেরিয়েছেন। তিনি তো একটি বারের জন্য কোনও কারচুপির কথা জানাননি!”
হাওড়া জেলাতেও বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। বিরোধীদের অভিযোগ: গত পঞ্চায়েত ভোটে উদয়নারায়ণপুরের ২০৭টি বুথে কোনও ভোট হয়নি। তাই এ বার সেখানে প্রতি বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি ওঠে। অথচ প্রশাসন উদয়নারায়ণপুরে দেয় স্রেফ আড়াই কোম্পানি। আর শ্যামপুরের মতো তুলনায় অনেক শান্ত এলাকায় প্রয়োজন না-থাকলেও দু’কোম্পানি ফোর্স মোতায়েন হয়।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মিত্রের কথায়, “শান্তিপূর্ণ এলাকায় এত কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া তো অপব্যবহারের সামিল!”
কেন এমন হল?
বীরভূমের এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় বাহিনী তুলে দেওয়া হয়েছিল ওসি-দের হাতে। ভোটের সময় তারা কোথায় ছিল, বলতে পারব না।” জেলা পুলিশ-সূত্রের খবর: বীরভূমের পুলিশ লাইনের অতিথিশালায় ৩০ এপ্রিল সারা দিন হাজির ছিলেন পশ্চিমাঞ্চলের আইজি সিদ্ধিনাথ গুপ্ত ও বর্ধমান রেঞ্জের ডিআইজি লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা। তবে ভোট চলাকালীন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের তরফে কয়েকশো অভিযোগ জমা পড়লেও দুই পুলিশকর্তা অতিথিশালা থেকে বেরোননি বলে অভিযোগ। যাতে চড়ে শীর্ষ কর্তাদের ভোট পর্যবেক্ষণে যাওয়ার কথা, বায়ুসেনার সেই হেলিকপ্টারও সিউড়ির চাঁদমারি ময়দানে দিনভর অলস পড়ে ছিল।
বীরভূমের মতো অভিযোগ বর্ধমানেও। জেলার বিরোধীদের বক্তব্য: মঙ্গলকোট-কেতুগ্রাম-আউসগ্রামের মতো অশান্ত এলাকায় পর্যাপ্ত বাহিনী না-রেখে অন্যত্র মোতায়েন করা হয়েছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে একই রকমের এত অভিযোগ শুনে কমিশন কী বলছে? জেলা প্রশাসনগুলিরই বা কী প্রতিক্রিয়া?
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ সোমবার যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমার কাছে এমন কোনও খবর নেই। নির্দিষ্ট নালিশ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।” বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের দাবি, “প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক জওয়ান পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্ধমানই একমাত্র জেলা, যেখানে সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী, ওয়েবকাস্টিং, ভিডিও ক্যামেরা, সাধারণ ক্যামেরা অথবা মাইক্রো অবজার্ভারের মধ্যে যে কোনও একটা বহাল ছিল।”
হুগলির জেলাশাসক মনমীত নন্দারও দাবি, “আমরা সব বিধি মেনে করেছি।” প্রশ্ন শুনে হাওড়ার জেলাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার শুভাঞ্জন দাস অবশ্য বলেন, “বাহিনী মোতায়েন করেন পর্যবেক্ষক। তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন।” সরকার কী বলছে?
রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবাব, “এটা নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। তাদের প্রশ্ন করুন।”