চন্দ্রকোনায় নিহত মইসন খানের শোকার্ত স্ত্রী সাজেদা বিবি। —নিজস্ব চিত্র।
ভোট যত এগোচ্ছে, রাজনৈতিক হিংসার পারদ চড়ছে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে।
শনিবার বর্ধমানের এক তৃণমূল কর্মী এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে এক সিপিএম কর্মী রাজনৈতিক হিংসার বলি হন। ওই দুই জেলায় হিংসা অব্যাহত। রবিবার রাতে ফের এক সিপিএম কর্মী খুনের অভিযোগ উঠেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায়। জেলারই পিংলায় সোমবার আক্রান্ত হয়েছেন দলের তিন নেতা। আর বর্ধমানের দুর্গাপুরে এক সিপিএম কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত তৃণমূল।
বর্ধমানে লোকসভার ভোট ৩০ এপ্রিল ও ৭ মে। পশ্চিম মেদিনীপুরে ভোট রয়েছে ৭ এবং ১২ মে। ভোট যত এগোচ্ছে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তত ধৈর্য হারাচ্ছেন এবং তার ফলে অশান্তি বাড়ছে বলে অভিযোগ সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের। সারদা প্রসঙ্গ টেনে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বক্তব্য, “ব্যাগ থেকে যত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াল বেরোচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন, প্ররোচনামূলক বক্তব্য রাখছেন। আর তাঁর দলের লোকজন অশান্তি বাধাচ্ছে।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, “সিপিএমের কুৎসা এবং অপপ্রচারের জন্যই কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। পরাজয় নিশ্চিত বুঝেই বিরোধীরা ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলছেন!”
রবিবার রাতে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় মইসন খান (৪২) নামে এক সিপিএম কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। নিহতের পরিবারের তরফে তৃণমূলের লক্ষ্মীপুর অঞ্চল কমিটির সভাপতি-সহ ১৮ জন দলীয় নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। তবে তৃণমূলের দাবি, মইসন তাদের দলীয় কর্মী। সোমবার সকালে ইঁদা গ্রামে বাড়ির অদূরে এক নালায় মইসনের দেহ মেলে। মইসনের স্ত্রী সাজেদা বিবির অভিযোগ, “রবিবার চালতাবাঁধি গ্রামে সভা আছে বলে তৃণমূলের লোকেরা জোর করে স্বামীকে ডেকে নিয়ে যায়। ও আর ফেরেনি। রাতে তৃণমূলের লোকেরাই ওকে খুন করেছে।” সিপিএমের চন্দ্রকোনা ১ জোনাল সম্পাদক বিদ্যুৎ রায় বলেন, “আমাদের দক্ষ সংগঠক মইসনকে বাগে আনতে পারেনি তৃণমূল। সেই ক্ষোভে ওকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।” জেলা পুলিশ সুপার শিসরাম ঝাঝোরিয়া বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে।”
তৃণমূলের চন্দ্রকোনা ১ ব্লক সভাপতি সুকুমার চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, “মইসন খান আমাদের দলের সক্রিয় সদস্য। রবিবার দলের এক সভাতেও তিনি ছিলেন। কী ভাবে তাঁর মৃত্যু হল পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে বলেছি।” দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে অভিযোগ প্রসঙ্গে সুকুমারবাবুর বক্তব্য, “সিপিএমের প্ররোচনায় মইসনের পরিবার এই কাজ করেছে।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, মইসনদের পরিবার সিপিএম সমর্থক হিসেবে পরিচিত। রাজ্যে পালাবদলের পর স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে দীর্ঘ দিন ঘরছাড়াও ছিলেন মইসন। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। সাজেদা বিবি বলেন, “ঘরে ফেরার জন্য তৃণমূলকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করেছিল আমার স্বামী।” মইসনের দেহ উদ্ধারের পর এ দিন পথ অবরোধ করে সিপিএম। রামজীবনপুর পুলিশ ফাঁড়িতেও বিক্ষোভ হয়। চন্দ্রকোনা এলাকাটি আরামবাগ লোকসভার অন্তর্গত। ওই কেন্দ্রের বাম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক মইসনের বাড়িতে যান।
সোমবার সকালে ঘাটালে কেন্দ্রের বামপ্রার্থী সন্তোষ রাণার সমর্থনে প্রচারে গিয়ে আক্রান্ত হন পিংলার সিপিএম জোনাল সম্পাদক-সহ তিন জন। অভিযোগ, ক্ষীরাইয়ের সুরথচকে তৃণমূলের লোকজন রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করে জোনাল সম্পাদক নয়ন দত্ত, মালিগ্রাম লোকাল কমিটির সদস্য সমীর মাইতি ও স্থানীয় নেতা নিতাই করকে। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
এ দিনই কেশিয়াড়িতে মহম্মদ সেলিমের সভায় যাওয়ার পথে তিন সিপিএম কর্মীকে তৃণমূলের লোকজন গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করেন বলে অভিযোগ। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত শনিবার গড়বেতায় সিপিএমের কর্মিসভার পরে তৃণমূল এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ। সে দিন কর্মিসভায় ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ। তাঁর অভিযোগ, “তৃণমূল গ্রামে গ্রামে গিয়ে আমাদের কর্মীদের হুমকি দিচ্ছে।” তৃণমূলের গড়বেতা ব্লক সভাপতি দিলীপ পালের পাল্টা অভিযোগ, “একটা কর্মিসভা করে সিপিএম নেতারা এমন উস্কানি ছড়ালেন যে, গ্রামে ফিরে ওদের দলের দুষ্কৃতীরা মানুষকে ভয় দেখাতে শুরু করল।”
রবিবার রাতে সিপিএম কর্মীর বাড়িতে চড়াও হয়ে মারধরের অভিযোগ উঠেছে দুর্গাপুরেও। প্রদীপ শিকদার নামে সিপিএমের ওই লোকাল কমিটির সদস্য হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর স্ত্রী শান্তাদেবী পুলিশে অভিযোগ করেন, কিছু তৃণমূল সমর্থক বাড়িতে ঢুকে প্রদীপবাবুকে লাঠি, রড দিয়ে মারধর করে। তৃণমূল অভিযোগ মানেনি। সোমবার রানিগঞ্জে আবার ইট ছুড়ে তৃণমূলের প্রচার-গাড়িতে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে।
সোমবার সকালে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। জখম হন তিন জনকে বহরমপুর মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছে।