কখন আসবে বাস? প্রতীক্ষা বিষ্ণুপুর বাসস্ট্যান্ডে।—নিজস্ব চিত্র
বাঁকুড়া মেডিক্যালে ডাক্তার দেখাতে আসার পথে তিন ঘণ্টা। ফেরার পথে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সেই বাসের জন্য ঠায় অপেক্ষা করতে হল ইঁদপুরের গৌরবাজারের ৭০ বছরের বৃদ্ধা ছবিবালা চন্দকে। সোমবার দুপুরে বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে তাঁর ক্ষোভ, “এই বয়সে এত ধকল সয় না।
অন্য দিনে কয়েক মিনিট অন্তর দুর্গাপুরের বাস পাওয়া যায়। কিন্তু এ দিন দুর্গাপুরগামী বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সতীঘাট বাসস্টপে অপেক্ষা করতে হয় বাঁকুড়ার স্কুলডাঙার সুব্রত নন্দীকে। শেষে দুর্গাপুরগামী একটি এসবিএসটিসি বাস পান। কিন্তু ভিড়ে ঠাসা বাসের ভিতরে তিনি ঢুকতে পারেননি। শেষে বাসের ছাদে উঠতে তিনি বাধ্য হন। তাঁর ক্ষোভ, “পেশার টানে যেতেই হবে। তাই জীবনের ঝুঁকি নিতেই হল।” গ্রামে কাজ নেই তাই পুবে খাটতে সিঙ্গুর যাচ্ছেন বান্দোয়ানের সুকান্ত হেমব্রম, সুনীল হাঁসদারা। বাঁকুড়া পর্যন্ত বাস পেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁকুড়া থেকে দুপুর পর্যন্ত তাঁরা বাস পাননি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বাস না পেয়ে তাঁদের ক্ষোভ, দিনটাই ‘মাটি’হয়ে গেল।
বস্তুত ‘মাটি তীর্থ কৃষি কথা’ উৎসবেই এ দিন বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাঁকুড়া থেকে প্রায় তিন হাজার কৃষককে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সেই মোতাবেক ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দও করা হয়। নির্দেশ বাস্তবায়িত করতে জেলার নানা প্রান্তের ১৯০টি বাস তুলে নেয় প্রশাসন। জেলায় বিভিন্ন রুটে প্রায় ৪০০টি বাস চলে। তার প্রায় অর্ধেক বাস মাটিতীর্থ উৎসবে তুলে নেওয়ায় দিনভর ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হলেন আমজনতা। অনেকের দিনটাই কার্যত মাটি হল।
জেলা প্রশাসনের তরফে এ দিন বাড়তি এসবিএসটিসি বাসও জেলায় চালানো হয়নি। কেন চালানো হয়নি তার সদুত্তর মেলেনি প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছ থেকে। অন্য দিকে, ছবিবালাদেবী, সুব্রতবাবু, সুকান্ত, সুনীলদের মতো জেলার নানা এলাকার কয়েক হাজার মানুষের দিনের কাজ পণ্ড হয়েছে। বাড়তি ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। জনজীবন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে যাত্রীদের মধ্যে।
বাঁকুড়া মহকুমার মতো বিষ্ণুপুর ও খাতড়া মহকুমাতেও ভোগান্তির একই চিত্র দেখা গিয়েছে। বাস না পেয়ে অনেককে মোটা টাকা খসিয়ে ভাড়া গাড়িতে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। এই পরিস্থিতির দায় কার? জেলাশাসক বিজয় ভারতীর কথায়, “রাজ্য থেকে নির্দেশ পেয়েই আমরা জেলার কৃষকদের নিয়ে যেতে বাস ভাড়া করেছি।” বিকল্প পরিবহণ ব্যবস্থা রাখেননি কেন? সদুত্তর মেলেনি। জেলা বাসমালিক সমিতির সম্পাদক দীপক সুকুলের বক্তব্য, “জেলা প্রশাসন বাস চেয়েছিল, আমরা তাঁদের সহায়তা করেছি।” এর বাইরে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে পুরুলিয়ার ছবিটা অন্য দিনের মতোই ছিল। বর্ধমানে মাটি তীর্থ কৃষি কথার অনুষ্ঠানে এই জেলা থেকে কম লোক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রশাসন ও জেলা বাস মালিকদের সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন জেলার বিভিন্ন রুট থেকে ২০টি বাসে কৃষক ও বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই জেলার ৪৭টি রুটে বেসরকারি বাসের সংখ্যা প্রায় ৩৫০। কাজেই ২০টি বাস তুলে নেওয়ায় যাত্রীদের বিশেষ ভুগতে হয়নি। প্রশাসন সূত্রের খবর, কিছু লাক্সারি বাস ওই সভার জন্য নেওয়া হয়েছিল। বস্তুত পুরুলিয়া থেকে বর্ধমানের দূরত্ব অনেকটাই। এ ছাড়া সামনেই পুরুলিয়ার হুড়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক জনসভা করতে আসার কথা। তাই এ দিন পুরুলিয়া থেকে লোক নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে।
তবে বাঁকুড়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলে বাস তুলে নিয়ে যাওয়ায় সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্রের কটাক্ষ, “জনগণের করের টাকা ফালতু কাজে ব্যয় করছে সরকার। তৃণমূলের ডাকে মাঠ ভরানো সম্ভব নয় বুঝেই প্রশাসনিক সভার নাম করে লোক তুলে আনা হচ্ছে।” বিজেপির জেলা মুখপাত্র অজয় ঘটক বলেন, “কেন্দ্রের নীতি আয়োগের বৈঠকে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যান না। আর রাজ্যে সরকারি টাকায় মেলা করে পয়সা ওড়ান। বাস তুলে নিয়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলেন!” বিরোধীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাম সরকার কৃষক, শ্রমজীবী মানুষদের কথা ভাবত না। আমাদের সরকার ভাবে। তাই মেলার মাধ্যমে কৃষকদের উন্নয়ন ও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করছে।”