অলোক দাস। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।
হঠাৎ থানা-পুলিশ হয়ে যাওয়ায় ফাঁপরে পড়ে গিয়েছেন। নিন্দুকেরা বলে, গ্রামের মানুষের নাম দিয়ে সিন্ডিকেট আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাণপণ। কিন্তু তৃণমূলের অলোক দাসকে অনেক দিন ধরেই চেনে বর্ধমানের জামুড়িয়া।
কে এই অলোক দাস?
স্থানীয় সূত্রের খবর, জামুড়িয়া ১ ব্লকের তালতোড় গ্রামের অলোক ১৯৯৮-এ তৃণমূলে যোগ দেন। ওই বছর পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে অলোক ও তাঁর দাদাকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। দুই ভাই ঘর ছাড়েন। ভানোড়া কোলিয়ারি লাগোয়া এলাকায় গিয়ে চা-জলখাবারের দোকান দেন।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০১ সালে তৃণমূল ছেড়ে অলোক আবার সিপিএম নেতাদের সাহায্যেই গ্রামে ফেরেন। ২০০৪ সালে জামুড়িয়াতেই লটারির ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই তা-ও গুটিয়ে ফেলতে হয় তাঁকে। লটারি কেটেও প্রাপ্য টাকা না মেলার অভিযোগে শিশিরডাঙায় তাঁকে মারধর করে গাছে বেঁধে রাখা হয়। সে বারও সিপিএম নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান।
তৃণমূলের একটি সূত্র দাবি করেছে, এর পরেই স্থানীয় সিপিএম নেতাদের হাত ধরে ‘উত্থান’ শুরু অলোকের। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, ওই সময়েই বীজপুর, কাঁচাগোড়িয়া ও রানিগঞ্জের টিবি হাসপাতাল লাগোয়া কোড়াপাড়ায় অবৈধ কয়লার কারবারে জড়ান অলোক। নিজের গরুর গাড়িতে তিনি কয়লা পাচার করতেন বলেও এলাকায় কানাঘুষো রয়েছে।
অলোকের বিরুদ্ধে কয়লা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে জামুড়িয়ার সিপিএম নেতা মনোজ দত্তের দাবি, “গত তিন বছরে ওঁর কী করে এত রমরমা হল, তা আমরা জানতে চাই।” তাঁর সংযোজন, “অলোক আমাদের দলে কখনও ছিলেন না।” অলোকের বক্তব্য, “আমার পারিবারিক যা সম্পত্তি রয়েছে, তাতে আমার কয়লা চুরি করার দরকার পড়ে না। তা মনোজবাবুরা ভাল ভাবেই জানেন।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সাফল্যর পরে অলোক ফের তৃণমূলে ফিরে আসেন। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে হয়ে ওঠেন সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। যদিও অলোক বলেছেন, “আমি বরাবরই তৃণমূলে ছিলাম। এখনও আছি।”
দলে ফিরেও অলোক বারবার শিবির বদল করেছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রথমে তিনি মলয় ঘটক-ঘনিষ্ঠ প্রদেশ সদস্য হারাধন ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছিলেন। বিধানসভা ভোটের কিছু দিন পরে জামুড়িয়া ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা মলয়-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা পূর্ণশশী রায়ের ঘনিষ্ঠ হন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবার অলোককে শিবির বদলে মলয় ঘটকের ভাই, যুব তৃণমূলের তদানীন্তন জেলা সভাপতি অভিজিৎ ঘটকের অনুগামী হয়ে উঠতে দেখছেন দলেরই অনেকে। দলের অন্দরের খবর, অলোকের জামুড়িয়া ১ ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি হওয়ার পিছনে অভিজিতের ভূমিকা রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশের অভিযোগ, যুব তৃণমূলে পদের সুযোগ নিয়েই চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায় ও গুণধর বাউড়ি নামে দুই শাগরেদকে নিয়ে বছর পঁয়তাল্লিশের অলোক ইকড়া শিল্পতালুকে একটি সিন্ডিকেট শুরু করেন। অভিযোগ, শিল্পতালুক থেকে বিভিন্ন সামগ্রী পাঠানোর সময়ে টন পিছু টাকা আদায় শুরু করে সেই সিন্ডিকেট। এর পরে শিবপুর, প্রেমবাজার, হুড়মাডাঙায় অবৈধ কয়লার ডিপো গড়ে ওঠে। নর্থ সিহারশোল খোলামুখ খনির বেশ কয়েকটি কোলিয়ারির কয়লাও পাচার করা শুরু হয়।
অলোক অবশ্য বলছেন, “কল-কারখানায় কাজ না পাওয়া কিছু বাসিন্দা তোলাবাজি, কয়লা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। আমি বা আমার দল এর সঙ্গে জড়িত নয়।”
ঘটনা হল, অলোকের বিরুদ্ধে এলাকায়, এমনকী দলেও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে আসানসোলের তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেনকে নিয়ে তালতোড় গ্রামে প্রচারে গেলে গ্রামে ঢোকার মুখেই অলোকের গাড়ি আটকানো হয়। নিজের গ্রামেই বিক্ষোভের মুখে পড়েন অলোক। গ্রামবাসীরা দোলার কাছে অভিযোগ করেন, অলোকের ভাবমূর্তি খারাপ। পর দিন অলোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে জামুড়িয়া ব্লক যুব তৃণমূলের কোর কমিটির চার সদস্যর মধ্যে তিন জন পদত্যাগ করেন। ওই কমিটিতে থেকে যান শুধু অলোকই।
কোর কমিটির পদত্যাগী সদস্যদের অন্যতম সত্যজিৎ অধিকারী বলেন, “তখনই অভিজিৎ ঘটকের কাছে আমরা লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম, অলোক দাস বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাথা। এর জেরে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ওকে না সরালে আমরা দল করব না।” এর পরেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন?
অভিজিৎবাবুর দাবি, অলোকের বিরুদ্ধে ওই ধরনের কোনও অভিযোগ কখনও ছিল না। এ বারেরও ঘটনাতেও তিনি জড়িত নন।