বাবুলের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হয়নি, মেনে নিলেন মলয়

মন্ত্রিত্ব খুইয়ে আসানসোল ফিরেই তড়িঘড়ি লোকসভা ভোটে দলের ভরাডুবির ব্যাখ্যা দিলেন মলয় ঘটক। মোদী-হাওয়ার ‘বেগ’ বুঝে উঠতে না পারা এবং বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ তুলে মামলা করা যে ঠিক হয়নি এ দিন তা কবুল করেন তিনি। সেই সঙ্গে দলীয় কর্মীদের ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’ও দলের পরাজয় ডেকে এনেছে বলে দাবি করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

আসানসোল শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ০২:৫১
Share:

আসানসোলে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকের পরে মলয় ঘটক (বাঁ দিকে)। —নিজস্ব চিত্র

মন্ত্রিত্ব খুইয়ে আসানসোল ফিরেই তড়িঘড়ি লোকসভা ভোটে দলের ভরাডুবির ব্যাখ্যা দিলেন মলয় ঘটক।

Advertisement

মোদী-হাওয়ার ‘বেগ’ বুঝে উঠতে না পারা এবং বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ তুলে মামলা করা যে ঠিক হয়নি এ দিন তা কবুল করেন তিনি। সেই সঙ্গে দলীয় কর্মীদের ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’ও দলের পরাজয় ডেকে এনেছে বলে দাবি করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী।

তবে তাঁর ব্যাখ্যা শুনে দলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “পরাজয়ের কারণ দর্শাতে গিয়েও সেই দলীয় কোন্দলকেই ঢাল করলেন মলয়।”

Advertisement

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সরকারি ভাবে ফল প্রকাশের আগেই, দলীয় প্রার্থী দোলা সেনের পরাজয় যে নিশ্চিত তা বুঝতে পেরেছিলেন আসানসোল কেন্দ্রের নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা মলয়। মর্যাদার-আসনে দোলার পরাজয়ে দলনেত্রী যে তাঁর উপরে যারপরনাই রুষ্ট, দলের এক শীর্ষ নেতার ফোনে সে কথা ওই দিন বিকেলেই জেনে গিয়েছিলেন তিনি। রাতেই কলকাতা পাড়ি দিয়ে তাই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন মলয়। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জানান, নিজের ‘নিরপরাধ অবস্থান’ ব্যাখ্যা করে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ‘কোপ’ থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। তৃণমূলনেত্রী অবশ্য সে রাতে তাঁর সঙ্গে দেখাই করেননি।

শুধু তাই নয়, মমতার নির্দেশে পরের দিনই তাঁকে মন্ত্রিত্ব এবং জেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকেও ইস্তফা দিতে হয়। টানা চার দিন কলকাতায় থাকলেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন মলয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বার কয়েক বৈঠক করেও মমতার ক্ষোভ যে সহজে পড়ার নয় বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত বুধবার রাতে আসানসোলে ফিরে আসেন তিনি।

এ দিন দুপুরে আপকার গার্ডেনে দলীয় কার্যালয়ে তাঁর অনুগামী নেতা-কর্মীদের নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বৈঠক করেন মলয়। আসানসোল পুরসভার ৩৩ জন দলীয় কাউন্সিলরকেই বৈঠকে ডাকা হলেও হাজির ছিলেন ২৪ জন। ছিলেন না মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে তিনি কলকাতায়। বাকিরা? মলয়-ঘনিষ্ঠ এক কাউন্সিলর বলেন, “সদ্য পদ-হারানো মন্ত্রীর বৈঠকে হাজির হয়ে অনেকেই শীর্ষ নেতৃত্বের কোপে পড়তে চাননি। তাই অনেকেই আসেননি।”

এ দিনের বৈঠক ডাকার পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। এক, মন্ত্রিত্ব খোয়ানোর পরেও দলের অন্দরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কতটা, তা যাচাই করে নেওয়া এবং হারের কারণ হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে যে ‘অন্তর্ঘাতের’ আঙুল উঠেছে, তা উড়িয়ে বিকল্প ব্যাখ্যা তুলে ধরতেই মলয় ও তাঁর অনুগামীদের এই উদ্যোগ। বৈঠকের ব্যাপারে মলয়ের ব্যাখ্যা, “লোকসভায় আমাদের জঘন্য পরাজয় হয়েছে। সামনেই আসানসোলে পুরভোট। সেখানে যেন এরকম না হয়, তা নিশ্চিত করতেই এই বৈঠক।”

তিনি বলেন, “আসানসোলের লাগোয়া ঝাড়খণ্ডে প্রবল মোদী-হাওয়া বইছিল। কিন্তু তার আঁচ যে এখানেও এ ভাবে আছড়ে পড়তে চলেছে, তা বুঝতে ভুল হয়েছিল।” তাহলে কি শুধুই মোদী হাওয়ার জোরেই উড়ে গিয়েছেন দলীয় প্রার্থী? দলের একাংশের মতে, আসানসোলে মলয়ই ছিল দলের মূল ভরসা। নিজেও একাধিক বার সে কথা সগর্বেই ঘোষণা করে দলের শীর্ষ নেতাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি। তাহলে মোদী-ঝড়ে কি রাতারাতি তাঁর দাপট উড়ে গিয়েছিল? নির্বাচনের সময়েও মলয় ও তাঁর অনুগামীদের নির্বাচনী প্রচারে সে ভাবে চোখে পড়ছে না বলে দলীয় প্রার্থী দোলা সেন বার বারই অভিযোগ করেছিলেন। দোলাদেবী তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে এ কথাও জানিয়েছিলেন, যে মলয় ‘সক্রিয়’ হলে বহু এলাকাতেই তাঁকে এ ভাবে পিছিয়ে পড়তে হত না। এ দিন সে অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মলয়।

তিনি বলেন, “বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা ও মদ্যপান করে প্রচারের যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তা ঠিক হয়নি। সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভাল ভাবে নেননি।” যা শুনে এ দিন বাবুলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, “তাহলে কি দেরিতে হলেও ভুলটা ওঁরা বুঝতে পেরেছেন?”

দলীয় সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, আসানসোলে মলয় ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি আলাদা গোষ্ঠী। বাবুলের বিরুদ্ধে মদ্যপ অবস্থায় প্রচারের অভিযোগ করেছিলেন আসানসোল সিটিজেন্স ফোরামের কর্তা সঞ্জয় সিংহ। তিনি আসানসোল পুরসভার চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র তিওয়ারির অনুগামী বলে পরিচিত। জিতেন্দ্রবাবু মেয়র তাপসবাবুর ঘনিষ্ঠ।

বাবুলের বিরুদ্ধে রানিগঞ্জে অস্ত্র আইনে যিনি মামলা করেছিলেন সেই সেনাপতি মণ্ডল আবার ওই এলাকায় মলয়-ঘনিষ্ঠ সোহরাব আলির বিরোধী বলে পরিচিত। জেলা তৃণমূলের একটি অংশের ধারণা, বাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গটি তুলে ভোটে হারের জন্য এলাকায় দলের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীকেই দোষারোপ করতে চাইলেন মলয়।

হারের পিছনে মলয়ের তৃতীয় দাবি, জলকষ্টে ভোগা এই শিল্পাঞ্চলে আসানসোল ও কুলটিতে দু’টি জল প্রকল্প রূপায়িত না হওয়া মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়েছিল।

২০০৬ সালে অনুমোদিত কুলটি জলপ্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের জেএনএনইউআরএম-এর বরাদ্দ টাকায় হওয়ার কথায় ছিল। কিন্তু প্রকল্প তৈরি নিয়ে এডিডিএ এবং কুলটি পুরসভার বিবাদ গড়িয়েছিল আদালতে। রাজ্যে পালাবদলের পরে তা মিটমাট হলেও প্রকল্পের কাজ কিন্তু এগোয়নি। শেষ পর্যন্ত গত বছর ওই প্রকল্পটিই বাতিল করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। আসানসোলেও ওই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আওতায় একশো কোটি টাকার জলপ্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল। ২০০৭ সালে বাম পুরবোর্ডের আমলে কাজ শুরুও হয়েছিল। ২০০৯ সালে পুরসভা দখল করে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। পাঁচ বছরে প্রকল্পের কাজ এগিয়েছিল সামান্য। শহরে জল সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি।

তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ, ওই দুই পুরসভার কর্তারা মলয়-ঘনিষ্ঠ নন বলে জলপ্রকল্পরে প্রসঙ্গ তুলে আসানসোল ও কুলটির পুর-কর্তাদের ঘাড়ে ভোটে ভরাডুবির দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।

মলয় অবশ্য বলছেন, “কোন্দলের প্রশ্ন নেই। তবে মন্ত্রী গিয়ে ভালই হয়েছে। এ বার এখানেই সময় দেবো।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement