চার দিকের সমালোচনা এবং ক্ষোভের মুখে অবশেষে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৭% মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চলতি মাসের বেতনের সঙ্গেই এই কিস্তির টাকা পাবেন কর্মীরা। কিন্তু এই ঘোষণায় অন্যরা তো বটেই, এমনকী তৃণমূল-প্রভাবিত ফেডারেশনের নেতারাও সন্তুষ্ট নন। কর্মচারীদের অভিযোগ, “মুখ্যমন্ত্রীর এক কিস্তি ডিএ ঘোষণায় কেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমে ৪২% হল ঠিকই। কিন্তু এ মাসেই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য ফের ৭% ডিএ ঘোষণা হতে পারে। ফলে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া তো সেই ৪৯%-ই থাকবে! বাড়তেও পারে!”
এ দিন ডিএ ঘোষণার পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ২৮ হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে কেন্দ্র। ওটা যদি না নিত, তা হলে আরও কিছু করতে পারতাম।” একই সঙ্গে রাজ্যের কর্মীদের ডিএ-র টাকা দিল্লি যাতে মেটায় সেই দাবি এ দিন ফের তুলেছেন তিনি। ৭% ডিএ দিতে কোষাগার থেকে ২১০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে জানান তিনি।
যদিও কেন্দ্র কেন রাজ্যের ডিএ-র টাকা মেটাবে, সেই প্রশ্ন উঠছেই। কেন কেন্দ্র বছরে দু’বার ডিএ দিতে পারে, অথচ তাঁর সরকার পারে না নিজের মতো করে তার একটি তত্ত্বও খাড়া করেছেন মমতা। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “টাকা ছাপানোর ক্ষমতা রাজ্য সরকারের নেই। আপনারা সেটা নিশ্চয়ই বোঝেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কটা রাজ্য সরকারের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের।”
সময় মতো ডিএ দিতে না পারার কারণ হিসেবে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজ্যের অর্থ দফতরের একাধিক অফিসার তা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, বাম আমলের তুলনায় গত তিন বছরে সরকারের রাজস্ব আদায় অনেকটাই বেড়েছে। সেই বাড়তি টাকায় উন্নয়নের বহু কাজ করা যেত। কিন্তু তা মোটেই করা হচ্ছে না। অর্থ দফতরের একাধিক কর্তার অভিযোগ, এই সরকারের তিন বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং পরিষেবার মতো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলির জন্য পরিকল্পনা খাতের বাজেট-বরাদ্দের টাকা পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি। অথচ ক্লাব-উৎসব-অনুষ্ঠান-খয়রাতি খাতে বহু কোটি টাকা স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার! ফি-বছর শুধু মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণ করতে এই সব খাতে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কর্মীদের অভিযোগ, আসলে সরকারি কর্মীদের ডিএ দেওয়াটা বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকাতেই নেই। ডিএ-প্রসঙ্গ উঠলেই আর্থিক সঙ্কটের কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রশাসনের এক কর্তা জানান, মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করার জন্যই সরকারি কর্মীদের ডিএ দেওয়া হয়। পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ ছিল, কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়া উচিত রাজ্যের। ডিএ বকেয়া থাকা অভিপ্রেত নয় বলে জানিয়েছিল বেতন কমিশন।
কিন্তু তাতে কর্ণপাত করছেন না নবান্নের কর্তারা। আর সেই কারণেই এ রাজ্যের বকেয়ার পরিমাণ দেশের মধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে।
কী রকম?
প্রশাসন সূত্রে খবর, কেন্দ্র তাদের কর্মীদের ইতিমধ্যেই ১০৭% ডিএ দিয়েছে। এ মাসে আরও ৭% ঘোষণা করলে অঙ্কটা ১১৪% হবে। সেখানে রাজ্যের কর্মীরা ডিএ পাবেন (এ দিনের ঘোষণা যুক্ত করে) ৬৫%। অথচ, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যই তাদের কর্মীদের হয় কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিচ্ছে, অথবা দু’-এক কিস্তি পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোজ গুহর দাবি, “এমনকী প্রতিবেশী অসম-বিহার-ওড়িশা-ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলিও কেন্দ্রীয় হারের সমান ভাতা দিচ্ছে, অথবা মাত্র এক-আধ কিস্তি পিছিয়ে আছে।”
এই প্রসঙ্গেই উঠেছে বাম আমলে ডিএ দেওয়ার প্রসঙ্গটি। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কারও আমলেই কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ডিএ-র ফারাক এখনকার মতো হয়নি। ব্যতিক্রম হিসেবে দু’-এক বার তিন-চার কিস্তি ডিএ বকেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বছরে দু’বারের বদলে তিন বার ডিএ দিয়ে সেই ব্যবধান কমিয়ে আনা হয়েছে। কো-অর্ডিনেশন কমিটির এক নেতার দাবি, বাম আমলের একেবারে শেষের দিকে কর্মীদের ১৬% ডিএ বকেয়া ছিল। বিগত সাড়ে তিন বছরে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৯%।