সপ্তাহের গোড়ার দিকে সারদা-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীকে জেরার দাবি নিয়ে তৃণমূল-বিরোধী মিছিল। সপ্তাহের শেষে সাম্প্রদায়িক সংহতিকে উপলক্ষ করে বিজেপি এবং তৃণমূল-বিরোধী মিছিল। দুই মিছিলেই উপচে পড়া ভিড়। বিশেষত, শনিবারের মিছিল আড়ে-বহরে টেক্কা দিয়েছে শহরেরই রাজপথে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মসূচিকে। পরপর দুই মিছিলের সাফল্যে সংগঠনের জন্য স্বস্তির বার্তা দেখছে আলিমুদ্দিন। রাস্তায় মিছিলের ভিড় ভোটবাক্স পর্যন্ত আদৌ পৌঁছবে কি না, তার আগাম আন্দাজ দুঃসাধ্য। কিন্তু বিরোধী রাজনীতির পরিসর হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের এ বার আড়ষ্টতা কাটছে বলেই মনে করছেন বামফ্রন্ট নেতৃত্ব।
মিছিলের জনজোয়ার সম্ভবত দাঁড়ি টানতে চলেছে ‘ফিশফ্রাই কূটনীতি’তেও। পাঁচ মাস আগে একগুচ্ছ দাবি নিয়ে নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ফিশফ্রাই-আপ্যায়ণ স্বীকার করায় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। আবার কি নবান্নে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে? বিমানবাবু বলছেন, “এক বার গিয়ে নবান্নে তো দাবিপত্র দিয়েছিলাম। আর তো সেই নিয়ে টুঁ শব্দ দেখলাম না! ওই দাবি নিয়ে আমরা সরব থাকব।” উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম ১৬ ডিসেম্বর শহিদ মিনারে সমাবেশের পরে নবান্নে দাবি জানাতে যাওয়ার কর্মসূচি রেখেছে।
মহাজাতি সদন থেকে রবীন্দ্র সদন পর্যন্ত বিরাট মিছিলের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আলিমুদ্দিনে প্রথমে বামফ্রন্টের শরিক ১১টি দল এবং তার পরে ফ্রন্টের বাইরে আরও ৬টি দলকে নিয়ে বৈঠকে বসেন বাম নেতৃত্ব। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার গণ্ডিতে আটকে না থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সমস্যাগুলি নিয়েও প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়। মিছিলের সাফল্য তাঁদের উৎসাহ বাড়িয়েছে। বৈঠকে ঠিক হয়েছে, ১১ ডিসেম্বর ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে তিন ঘণ্টার ধর্না-করবে ১৭টি বাম দল। প্রতিবাদের বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে ১০০ দিনের প্রকল্প ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধি এবং ওষুধের বাড়তি দাম, বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, সংখ্যালঘু, মহিলাদের উপরে অত্যাচার প্রভৃতি। সোমবার থেকেই দেশ জুড়ে প্রচার চলবে। বিমানবাবুর নির্দেশ, ১১ তারিখ কলকাতায় তাঁদের ধর্নার পরে শেষ তিন দিনে প্রতিটি জেলা সদরে এবং সম্ভব হলে মহকুমা শহরেও ধর্না-বিক্ষোভ করতে হবে।
কর্মসূচি আসলে সংগঠনকে চাঙ্গা রাখারই কৌশল। যে উৎসাহ-বার্তা তাঁরা মিছিল থেকে পেয়েছেন, তাকেই ধরে রাখার চেষ্টা। দুই মিছিলে বিপুল সাড়াকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করছেন? বিমানবাবু রবিবার আনন্দবাজারকে বলেন, “আস্তে আস্তে জড়তা কাটছে। আমাদের মুখের কথায় যারা ঘর থেকে বেরোচ্ছিল না, তাদের অনেকে অভিজ্ঞতা থেকেই বাইরে আসছে।” তৃণমূল জমানার শুরুর দিক থেকে প্রথমে মার খেয়ে এবং পরে ভোটে ধাক্কা খেয়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশই ঘরে বসে পড়েছিলেন। সিপিএমের চলতি সম্মেলন-পর্বে নিষ্ক্রিয় কর্মীদের ছেঁটে ফেলারও প্রক্রিয়া চলছে। তার মধ্যেই বাম কর্মী-সমর্থকদের জড়তা ভেঙে বেরোনোকে ইতিবাচক মনে করছেন বিমানবাবুরা।
বাম শরিক দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “সাম্প্রতিক কালে যাঁরা আমাদের ছেড়ে তৃণমূল বা বিজেপি-তে গিয়েছেন, তাঁরা ফিরে আসছেন এমন ভাবা ঠিক নয়। বাম দলে থেকেও যাঁরা বসে গিয়েছিলেন, তাঁদের বড় অংশ বুঝতে পারছেন, বসে থাকলে বেঁচে থাকাই মুশকিল! এঁরা বেরোতে শুরু করেছেন।” এই বাম নেতাদের অভিমত, তৃণমূল যা ঘর ভাঙার, সে তো ভেঙেছেই। এর পরেও নিশ্চেষ্ট থাকলে বিজেপি বাকি জায়গাটুকু দখল নিয়ে নেবে বুঝতে পেরেই আড় ভাঙছে কর্মী-সমর্থকদের।
শনিবার পুলিশ দিয়ে বামেদের মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা এবং তৃণমূলের সমাবেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকেও কটাক্ষ করেন বিমানবাবু। তাঁর মন্তব্য, “গাঁধীজির মূর্তির সামনে সভা করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না! রাজ্য জুড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে, তার মধ্যে কী ভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই হবে?” জবাবে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “এমন কাপড় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যা দিয়ে বিমানবাবুদের মুখ ঢাকা যায়! ৩৪ বছরে যাঁরা সব রকম অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত তুলে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইকে খাটো করার চেষ্টা করছেন!”
চট নিয়ে সরব তৃণমূল, আলাদা প্রতিবাদে বাম
চটের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হাত মেলাচ্ছে না তৃণমূল ও বামেরা। দু’পক্ষই প্রতিবাদের পথে যাচ্ছে নিজেদের মতো করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে দলের সাংসদেরা আজ, সোমবারই সংসদের বাইরে এই নিয়ে প্রতিবাদে নামছেন। আবার বাম-সহ ২০টি শ্রমিক সংগঠন দ্বারস্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় বস্ত্র ও শ্রমমন্ত্রীর।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সম্প্রতি বস্ত্র মন্ত্রকের কাছে নোট পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে, বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল রেখে জুট প্যাকেজিং মেটেরিয়াল (জেপিএম) আইনের পর্যালোচনা দরকার। খাদ্যশস্য ভরতে বস্তার ব্যবহার কমানো এবং পরে ওই ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। মঙ্গলবারই সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী এবং দলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সেরেছেন মমতা। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিবার বলেন, “চটশিল্প এবং শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। চটশিল্পকে ধ্বংস করার পথে কেন্দ্রীয় সরকার যাতে না যায়, সেই আর্জিই জানাচ্ছি। কেন্দ্র সতর্ক না হলে প্রতিবাদ করেই কথা শোনাতে হবে!” এআইটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি দেবাশিস দত্তের যুক্তি, এ রাজ্যে সম্প্রতি চটশিল্পের সঙ্কট কাটাতে সরকার কোনও ভূমিকা নেয়নি। ২৬ নভেম্বর রাজ্যে ২০টি ইউনিয়নের ডাকা চটকল ধর্মঘটেও তৃণমূলের আইএনটিটিইউসি যোগ দেয়নি। তাই তৃণমূলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে না গিয়ে তাঁরা ২০টি ইউনিয়নের তরফে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার ও শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়ের কাছে প্রতিবাদ জানাবেন। ফেডারেশন অফ চটকল মজদুর ইউনিয়নের তরফে দেবাশিসবাবু আইজেএমএ-কে একটি চিঠি দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘পাট চাষি বাঁচাও, পাট শ্রমিক বাঁচাও’ লক্ষ্য নিয়েই তাঁরা কেন্দ্রের উদ্যোগের প্রতিবাদ করছেন। এর আগেও কেন্দ্রের দিক থেকে এমন উদ্যোগ আটকানো হয়েছিল রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রচেষ্টায়।