মঙ্গলবার ধর্মতলায় বিজেপির জনসভায় মমতা-বিরোধী বক্তৃতা দিচ্ছেন নিতিন গডকড়ী। তার পরেই নবান্নে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে, তাঁকে ফুল-মিষ্টি দেন কেন্দ্রীয় জাহাজ ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী। ছবি: সুদীপ আচার্য
কেউ বলতেই পারেন, ‘ধর্মতলায় কুস্তি! নবান্নে দোস্তি!’
কিন্তু কেন্দ্রীয় জাহাজ ও সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর মঙ্গলবারের কলকাতা-সফর দেখাল, রাজনীতির কুস্তি আর সরকারি কাজে দোস্তির কোনও বিরোধ নেই! এবং দেখাল, উন্নয়নে কেন্দ্র-রাজ্য সুষ্ঠু সমন্বয় থাকলে রাজনীতির কাঁটার তীব্র খোঁচাও মিষ্টি-সহযোগে হয়ে যেতে পারে সৌজন্যের গোলাপ!
গডকড়ীর সফর যেমন!
এ দিন কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিজেপির মিছিলে যোগ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আগামী বিধানসভা ভোটে উৎখাত করে বাংলায় ‘আচ্ছে দিন’ আনার ডাক দিয়েছেন দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি। আবার মিছিল শেষে ফুল-মিষ্টি হাতে নবান্নে গিয়ে সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতারই মুখোমুখি বসে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন আটকে থাকা প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার লগ্নি-জট ছাড়াতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গডকড়ী। রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দান থেকে উঠেই উন্নয়নের জন্য সহযোগিতার মঞ্চে চলে যাওয়া কার্যত দেখাই যায় না এ রাজ্যে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শত রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রশ্নে আলোচনায় বসতে বাধা ছিল না আহমেদ পটেলের। কিন্তু এ রাজ্যের ‘সংস্কৃতি’ ঠিক তেমন নয়! মাত্র ক’দিন আগেই আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় রাজ্যে এসে বৈঠক ডাকার পর পুর দফতরের অফিসারেরা সেই বৈঠকে থাকার ব্যাপারে অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।
অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব গোড়া থেকেই বলে আসছেন, রাজনীতির লড়াই দল করবে। কিন্তু সরকারি স্তরে সাংবিধানিক কাঠামো মেনে কোনও রাজ্যের সঙ্গেই সহযোগিতাতেই তাঁদের আপত্তি নেই। মোদী-অমিত শাহের সেই নীতিরই এ দিন বাস্তব প্রয়োগ দেখা গিয়েছে গডকড়ীর দ্বৈত ভূমিকায়। পাশাপাশি রাজ্যের এক মন্ত্রী বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। গডকড়ী তো রাজ্যে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। রাস্তায় নেমে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন জেনেও মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তাঁর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক করেছেন।”
এ দিন সকালে কলকাতায় পৌঁছে প্রথমে দলের সভায় যোগ দেন গডকড়ী। সারদা-কাণ্ডের ধাক্কায় বেসামাল তৃণমূল পাল্টা প্রচারে নেমেছে সহারা-কর্তার সঙ্গে মোদীর ছবি নিয়ে। তারই প্রতিবাদে এ দিনের মিছিলের পর বক্তৃতা দেন গডকড়ী, রাজ্যে বিজেপির পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এবং রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। মোদীর উন্নয়নের রাজনীতিতে রাজ্যবাসীকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গডকড়ী বলেন, “বাংলাতেও পদ্ম ফুটবে। আঁধার ঘুচবে! আলো ঝলমল করবে।” আর মুখ্যমন্ত্রীকে রাহুলবাবুর চ্যালেঞ্জ, “২০১৫ সালেই বিধানসভার ভোট ডেকে দিন! সীতাদেবীর মতো মমতাদেবীর অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাক! বিজেপি এবং জনগণ তৈরি আছে!”
প্রবল তৃণমূল-বিরোধী এই জমায়েতের পরে নবান্নে যান গডকড়ী। বলে যান, “উন্নয়নের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রাজনীতি করবে না। সেই কারণেই ১০ হাজার কোটি টাকার সড়ক প্রকল্প রূপায়ণের বার্তা নিয়ে মমতাজি’র সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছি।” নবান্নে গডকড়ী এবং মমতা পরস্পরকে গোলাপ দিয়ে অভ্যর্থনা করেন। ঘণ্টাদুয়েক বৈঠকের পর দু’জনেই জানান, পারস্পরিক সহযোগিতায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলি এগোবে। উন্নয়নের প্রশ্নে কোনও দলাদলি, রাজনীতি হবে না।
বিজেপির মহিলা ব্রিগেড। মঙ্গলবার কলেজ স্ট্রিটে। ছবি: প্রদীপ আদক
গডকড়ী জানান, মমতার সঙ্গে আলোচনা করে অনেক পুরনো সমস্যা মিটে গিয়েছে। কেন্দ্র যে সব প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে এই রাজ্যের আরও দ্রুত বিকাশ হবে। মুখ্যমন্ত্রী জমি পেতে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সেই জন্য তাঁকে ধন্যবাদও জানান গডকড়ী। মমতা জানান, গডকড়ী এ দিন অফিসারদের একটি টিম নিয়ে এসেছিলেন। কেন্দ্রের প্রকল্পগুলি রূপায়ণের জন্য রাজ্য সরকার সহযোগিতা করবে। আগামী ৭ জানুয়ারি সাগর বন্দরের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রীকে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মমতা। গডকড়ী সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন বলে জানান তিনি।
সাগরে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে প্রস্তাবিত ওই বন্দরের নাম মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন ‘ভোরসাগর’। গডকড়ী জানান, ওই বন্দরের নাব্যতা হবে সাড়ে ১৩ মিটার। ফলে বড় জাহাজ সরাসরি সাগর বন্দরে আসতে পারবে। প্রকল্পে খরচ হবে ১২ হাজার কোটি টাকা। সাগরের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ গড়তে এত দিন একটি রেল-রাস্তা-সহ সেতুর প্রস্তাব ছিল। তার বদলে নদীর নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে রেল এবং রাস্তা তৈরি হবে। এই প্রকল্পের খরচ কোথা থেকে আসবে? মন্ত্রী জানান, পৃথিবীর অন্যতম সেরা এক উপদেষ্টাকে প্রকল্পের নকশা করতে বলা হয়েছে। আরও নানা প্রকল্পে প্রায় ১৫ হাজার কোটি বিনিয়োগ হবে বলে জানান গডকড়ী। দিনের শেষে তাই গোলাপেরই জিত। আম রাজ্যবাসী অন্তত তেমনই বলছেন।