রসায়নের শিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদার শান্তিনিকেতনে কবির স্নেহচ্ছায়ায় কালক্রমে রবীন্দ্রগানের শিল্পী ও দিকপাল গুরু হয়ে উঠেছিলেন। উপরন্তু ছিলেন আইনের স্নাতকও।
টালিগঞ্জের শতদ্রু সিংহ পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকলারও সর্বোচ্চ পাঠ নিয়ে ভ্যান গঘের মাস্টারপিস ‘দ্য স্টারি নাইট’-এর রহস্য ভেদ করতে চায়।
রবীন্দ্র-আনুকূল্যে শৈলজারঞ্জন বিগত শতকে যে-সুযোগ পেয়েছিলেন, এই শতাব্দীতে তরুণ শতদ্রু কি সেটা পেতে পারেন না?
অবশ্যই পেতে পারেন, আশ্বস্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি। এবং শুধু আশ্বাসেই থেমে থাকছে না তারা। চলতি বছরের মধ্যেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট’ (কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, ললিতকলার ভেদাভেদ উড়িয়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ) পঠন-পদ্ধতি চালু করতে হবে বলে শুক্রবার কলকাতায় এসে জানিয়ে দিয়েছেন ইউজিসি-র চেয়ারম্যান বেদপ্রকাশ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বেদপ্রকাশ এ দিন বলেন, ‘‘সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই উচিত চয়েস বেসড ক্রেডিট ব্যবস্থার আওতায় চলে আসা। এতে শুধু যে পড়াশোনার মান বাড়ে তা-ই নয়, পড়াশোনার ক্রমব্যাপ্তি ঘটে সুবিশাল ক্ষেত্র জুড়ে।’’
চয়েস বেসড ক্রেডিট ব্যবস্থাটা কী?
এই নিয়ম অনুযায়ী যে-কোনও শাখার যে-কোনও পড়ুয়া নিজের পছন্দমতো যে-কোনও বিষয় বেছে নিতে পারবেন। অর্থাত্ রসায়ন বা অঙ্ক পড়তে পড়তে যদি কোনও পড়ুয়ার মনে হয় একই সঙ্গে চিত্রকলা নিয়েও পড়াশোনা করবেন, সেই বিষয় বেছে নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে তাঁর। এমনকী যদি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিশেষ বিষয়টি পড়ানোর বন্দোবস্ত না-থাকে, সে-ক্ষেত্রে তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনায়াসে সেই বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারবেন। এবং তার জন্য আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বা রসায়ন পড়া চালিয়ে
যেতে তাঁকে কোনও অসুবিধার মুখে পড়তে হবে না।
এই নিয়মে পরীক্ষা ব্যবস্থাকেও হতে হবে সেমেস্টার-ভিত্তিক। এবং মূল্যায়ন মোটেই নম্বরের ভিত্তিতে হবে না। সেটা হবে পুরোপুরি ‘গ্রেডিং’ পদ্ধতিতে। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমেস্টার পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন শাখা থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিজের পছন্দমাফিক বিষয় বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা নেই এখনও।
ইউজিসি-র নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয় কি এখনই এই পছন্দ-ভিত্তিক পদ্ধতিতে পঠনপাঠন শুরু করতে পারবে?
‘‘স্নাতকোত্তর স্তরে বিষয়টি শুরু করার পরিকল্পনা আছে। এই ক্রেডিট ব্যবস্থা চালু রয়েছে বিদেশে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ থেকেও কিছু পড়ুয়া পড়াশোনা করতে আসছেন। ফলত আমাদের ব্যবস্থায় পড়াশোনা করতে কিছু সমস্যা হচ্ছে তাদের,’’ বললেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুগত মারজিত।
এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বিষয়গত বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি। এ রাজ্যে বহু কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়োপযোগী অনেক বিষয়েরই পঠনপাঠন হয় না। এমনকী প্রয়োগমূলক পড়াশোনার পাটও নেই রাজ্যের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন এক পরিস্থিতিতে কি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে চলতি বছরেই এই ক্রেডিট ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব?
২০১৬ সালের মধ্যে ওই ব্যবস্থা চালু করা যে কার্যত অসম্ভব, সেটা স্বীকার করে নিয়েই সুগতবাবু বলেন, ‘‘এই প্রণালী চালু করার আগে সব বিশ্ববিদ্যালয়কেই আরও অনেক আলাপ-আলোচনা করতে হবে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষ জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে সেমেস্টার পদ্ধতি এবং গ্রেডিং প্রথা চালু হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু দিন আগে। তবে ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট’ বা ইচ্ছামতো বিষয় নির্বাচনের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এই অবস্থায় চলতি বছরের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চয়েস বেসড ক্রেডিট পদ্ধতি চালু করার আগে যে উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি এবং বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন আছে, তা স্বীকার করছেন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরাই।