দুপুরের দিকে তিন মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ বার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু শুক্রবার দিনের শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে সাংবাদিকেরা যখন নবান্নে তাঁদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ তুললেন, মুখ্যমন্ত্রী কর্ণপাত করলেন না! ফলে সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের ঠান্ডা লড়াই জিইয়েই থাকল।
শুক্রবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে তিন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিম নবান্নের প্রেস কর্নারে এলে সাংবাদিকেরা তাঁদের কাছে নিজেদের বক্তব্য জানাতে চান। প্রসঙ্গ: নবান্নের অন্দরে সংবাদমাধ্যমের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার করার হুঁশিয়ারি। ক’দিন আগে যে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও সাংবাদিকেরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এ দিন কিন্তু সুব্রতবাবু-পার্থবাবুরা অভিযোগটি শোনেন। এবং শোনার পরে ওঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল, “সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকার যে সার্কুলার জারি করেছে, সেটাই তো আমরা জানি না!”
সাংবাদিকদের অনুযোগ মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন মন্ত্রী চলে যান। কিছু ক্ষণের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের এক আধিকারিক প্রেস কর্নারে বার্তা পাঠিয়ে জানান, সাংবাদিকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলতে চাইছেন। সেই মতো সাংবাদিকেরা চোদ্দো তলায় যখন উঠতে যাচ্ছেন, তখনই অন্য খবর আসে। জানা যায়, ওই তিন মন্ত্রীই ফের প্রেস কর্নারের পোডিয়ামে আসছেন। তাঁরাই যা বলার বলবেন।
দ্বিতীয় দফায় সুব্রতবাবুরা অবশ্য মূল প্রসঙ্গের ধার-কাছ মাড়াননি। সিবিআইয়ের হাতে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের গ্রেফতারি সম্পর্কে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তাঁরা পোডিয়াম ছাড়েন। যাওয়ার আগে এক মন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে যান, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের এক সহকর্মীর গ্রেফতারের খবর আসায় তা বানচাল হয়ে গেল।”
সুব্রত-পার্থ-ফিরহাদ বিদায় নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের এক কর্তা প্রেস কর্নারে হাজির হন। সঙ্গে আইআরসিটিসি-র তিন কর্মী, যাঁদের হাতে বিস্তর খাবারের প্যাকেট। “সাংবাদিকদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী খাবারের আয়োজন করেছিলেন। প্যাকেটগুলো উনিই প্রেস কর্নারে পাঠিয়ে দিলেন।” বলেন তিনি। সাংবাদিকেরা জানিয়ে দেন, প্যাকেট নেবেন না। কিছুক্ষণ কাটতে ফের মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের ফোন আসে সাংবাদিকদের মোবাইলে। বার্তা, “আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে মুখ্যমন্ত্রী প্রেস কর্নারে যাবেন। অনুরোধ, সকলে যেন থাকেন।”
খানিকক্ষণ বাদে দেখা যায়, তথ্য দফতরের ওই অফিসারকে (যিনি আগে প্যাকেট দিতে এসেছিলেন) নিয়ে প্রেস কর্নারে ঢুকছেন মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক আধিকারিক। তাঁর অনুরোধ, মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো খাবারের প্যাকেট সাংবাদিকেরা যেন ফিরিয়ে না দেন, এবং মুখ্যমন্ত্রী পোডিয়ামে আসার আগেই যেন সকলে খেয়ে নেন। সাংবাদিকেরা ওঁকে জানান, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। পরে এক সঙ্গে খাবেন। শুনে আধিকারিকটি আর কথা বাড়াননি।
শেষমেশ সন্ধে সওয়া ছ’টা নাগাদ পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবুকে নিয়ে প্রেস কর্নারের পোডিয়ামে আসেন মমতা। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েই তিনি মদন মিত্রের গ্রেফতারি নিয়ে বলতে শুরু করেন। প্রায় আধ ঘণ্টা এ ব্যাপারে একটানা প্রতিক্রিয়া পেশ করে সাংবাদিকদের বলেন প্রশ্ন করতে। ওই বিষয়ে তিন-চারটে প্রশ্নের জবাবও দেন। কিন্তু যখনই এক সাংবাদিক তাঁকে নিজেদের কাজের অসুবিধার কথা জানাতে চাইলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলে উঠলেন, “ও সব পরে শুনব।” বলেই প্রেস কর্নার ছেড়ে বেরিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। সাংবাদিকেরাও তাঁর পাঠানো খাবারের প্যাকেট নেননি।
নবান্নে উদ্ভুত এ হেন পরিস্থিতির সূত্রপাত ক’দিন আগে। রাজ্য প্রশাসনের সদরে সাংবাদিকদের গতিবিধিতে রাশ পরানোর লক্ষ্যে এ বছরের জানুয়ারিতে সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করলেও এত দিন তা কিছু শিথিল ছিল। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে পুলিশ তা বলবৎ করেছে। যার পিছনের কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রীর ‘রোষের’ দিকে আঙুল তুলেছে নবান্নের একাধিক সূত্র। কী রকম?
সূত্রের ব্যাখ্যা: ক’দিন আগে কয়েক জন সাংবাদিক অমিতবাবুর ঘরে গেলে তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। লালবাজারে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, সংবাদমাধ্যম কী ভাবে ওই পর্যন্ত পৌঁছে গেল? এই ঘটনারই জেরে নবান্নের প্রেস কর্নারের বাইরে সাংবাদিকদের যাতায়াতের উপরে পুলিশ কঠোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করে। ডিসি (রিজার্ভ ফোর্স) সিদ্ধান্তটির কথা জানিয়েও দেন।
সেই ইস্তক নবান্নে ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে সংবাদমাধ্যম।