পুরো বেতন চেকেই নিতাম, ব্যাখ্যা দিলেন অপর্ণা

নিয়োগপত্রে খাতায়-কলমে যা লেখা, তার বাইরে তিনি সারদা-গোষ্ঠী তথা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে কানাকড়িও পাননি বলেই এ বার দাবি করলেন অপর্ণা সেন। বুধবার আনন্দবাজারকে তিনি জানিয়েছেন, সারদা-গোষ্ঠীর প্রকাশিত মেয়েদের একটি পাক্ষিক পত্রিকা ও মিডিয়া স্কুলের সিইও হিসেবে নিয়োগের পরে যা পেয়েছেন, তা নিয়ে কোনও রকম ধোঁয়াশা নেই।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৪
Share:

উদ্বিগ্ন। বুধবার নিজের বাড়িতে অপর্ণা সেন। ছবি: শৌভিক দে।

নিয়োগপত্রে খাতায়-কলমে যা লেখা, তার বাইরে তিনি সারদা-গোষ্ঠী তথা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে কানাকড়িও পাননি বলেই এ বার দাবি করলেন অপর্ণা সেন।

Advertisement

বুধবার আনন্দবাজারকে তিনি জানিয়েছেন, সারদা-গোষ্ঠীর প্রকাশিত মেয়েদের একটি পাক্ষিক পত্রিকা ও মিডিয়া স্কুলের সিইও হিসেবে নিয়োগের পরে যা পেয়েছেন, তা নিয়ে কোনও রকম ধোঁয়াশা নেই। অপর্ণার মন্তব্য, “সবটাই আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও আয়কর সংক্রান্ত নথিতে পরিষ্কার।” ঠিক দু’দিন আগে ইডি-র দফতরে টানা ছ’ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে অবশ্য সারদা-গোষ্ঠীর কাছে তাঁর বেতন-সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি তিনি।

কেন চাননি, এ দিন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন চিত্রপরিচালক-অভিনেত্রী। তাঁর বক্তব্য, ইডি-র দফতর থেকে বেরনোর সময়ে টিভি ক্যামেরার হুড়োহুড়ি ও প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কথা বলার পরিস্থিতি ছিল না। এ দিন সরাসরি তিনি বলেন, “মাইনের পুরোটাই আমি চেকে পেতাম। তার বাইরে কোনও লেনদেনই ছিল না।” ইডি সূত্রের খবর, খাতায়-কলমে অপর্ণার মাসিক বেতন ছিল ৭ লক্ষ টাকা। টিডিএস বাবদ খানিকটা কেটে তাঁকে ছ’লক্ষ টাকার কিছু বেশি দেওয়া হতো। এই তথ্যের সত্যতা মেনে নিয়েই অপর্ণা এ দিন জানিয়েছেন, ফিল্মজগতের পরিচিতি তথা সমাজ সচেতন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে তাঁর যা ব্র্যান্ডিং, তাতে এই টাকাটা অন্যায্য নয়। এ ছাড়া, কাজে যথেষ্ট সময়ও দিতেন তিনি।

Advertisement

তবু দায়িত্বশীল এক জন নাগরিক হিসেবে অপর্ণা সেন কেন সারদার মতো একটি ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করলেন, এই প্রশ্নটাও শুরু থেকেই উঠছে। তিনি এ দিন সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন: গোড়ায় সারদার কয়েকটি সংবাদপত্রের সুবাদে তিনি তাদের প্রকাশনা সংস্থা বলেই জানতেন। বাংলা খবরের কাগজে একটি সাপ্তাহিক কলাম লিখতে শুরু করেন তিনি। পরে এক পরিচিতের মাধ্যমে ডেকে সুদীপ্ত তাঁকে পত্রিকা শুরু করার প্রস্তাব দেন।

তবে অপর্ণা বলেন, “ওটা (সারদা) যে চিট ফান্ড, তা শেষ দিকে বুঝতে পারি! কিন্তু ওই ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থা তো কতই আছে! ওদের যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র নেই, তা তো জানতাম না।” তবে বহু ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্র নির্মাণ বা পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে কার টাকা লগ্নি করা হচ্ছে, তা দেখা হয় না বলেও এ দিন মেনে নেন অপর্ণা।

কিন্তু ধরা পড়ার পর থেকেই সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেন বার বার বলে আসছেন, মিডিয়ার এই ব্যবসাই তাঁর ভরাডুবির কারণ। এর জন্য নামে-বেনামে বিপুল অর্থ তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে বলেও জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সেই সূত্রেই সুদীপ্তের ব্যবসায় অপর্ণা সেনের ভূমিকা কী সরেজমিনে তদন্ত করে জানতে চায় ইডি। খাতায়-কলমে চুক্তির বাইরে নগদে কোনও টাকা দেওয়া হতো কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে তারা। তাঁকে যে বেতন দেওয়া হতো বলে সুদীপ্ত দাবি করেছেন, আর অপর্ণা যে টাকা পেতেন বলে জানিয়েছেন, তা মিলিয়ে দেখাটাও এই তদন্তের অঙ্গ।

অপর্ণা সেনের দাবি, দু’টি অঙ্কে বড়-সড় গরমিল নেই। তিনি বলেন, “সুদীপ্ত আমার ব্যাপারে কী বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটিও আমায় দেখানো হয়। প্রতি পাতায় আমায় সইও করানো হয়েছে। যা দেখলাম, সুদীপ্ত বরং কিছু কম টাকার হিসেব দিয়েছিলেন। হয়তো ওঁর কিছু ভুল হয়েছে। আমি জানিয়েছি, উনি (সুদীপ্ত) যা বলছেন, আমি তার থেকে একটু বেশি টাকা পেয়েছি।” এর বাইরে সারদা সংস্থা বা সারদার মিডিয়ায় তাঁর কোনও অংশীদারিও যে ছিল না, তা তিনি ইডি-কে স্পষ্ট জানিয়েছেন বলেই দাবি করেন অপর্ণা। এমনকী, পত্রিকার রোজকার কাজে সম্পাদক হিসেবে ছোটখাটো টাকা খরচের এক্তিয়ার পর্যন্ত তাঁর ছিল না বলেই এ দিন বলেন তিনি।

অপর্ণা বলেন, “কোনও মডেলের ফটোসেশনের জন্য টাকা দিতেও সুদীপ্তবাবুর সই করানো চেক লাগত। সব সময়ে উনি থাকতেন না, খুব দরকারেও ওঁর সঙ্গে সহজে দেখা করা যেত না! এতেও খুবই অসুবিধে হতো।” তবে অপর্ণার অধীনে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের মাইনে বা পদোন্নতির সুপারিশ অবশ্য তিনিই করতেন। নতুন কারও নিয়োগ হলে সেটাও তাঁর সম্মতিতেই হতো।

কিন্তু পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি যে মিডিয়া স্কুলের সিইও হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন, সেই সংস্থাটির অস্তিত্বই দেখা গেল না কেন? অপর্ণার বক্তব্য, “আমার কাছেও এটা হতাশার জায়গা! মিডিয়া স্কুলটার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাগিদেই আমি সারদায় যোগ দিই।” টালিগঞ্জের কাছাকাছি কোথাও সংস্থাটি খোলার পরিকল্পনা ছিল। তা হলে শিক্ষার্থীরা মাঝেমধ্যে টালিগঞ্জের স্টুডিওয় গিয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারতেন। অপর্ণার দাবি, “যে বছর দুয়েকের কাছাকাছি সারদার সঙ্গে ছিলাম, সেই সময়ের মধ্যে মিডিয়া স্কুলের জন্য পছন্দসই জমি পাওয়া যাচ্ছিল না বলে শুনেছি!”

তবে সারদায় যত দিন কাজ করেছেন, তার মধ্যে আবার বেশ কয়েক মাস তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা মাইনে পাননি বলে জানিয়েছেন অপর্ণা। তাঁর কথায়, “বোধহয় পাঁচ থেকে আট মাসের মাইনে বাকি আছে। এ ছাড়া, শুরুর দিকেও চেক বাউন্স করেছিল।” কিন্তু ঠিকঠাক বেতন না-পেয়েও এই চাকরি কেন ছেড়ে দিলেন না তিনি? অপর্ণার জবাব: “আমি ছেড়ে দিলে পত্রিকাটিই বন্ধ হয়ে যেত। আমার স্বামী যথেষ্ট রোজগার করেন। আমার নিজের জন্য চাকরিটা জরুরি ছিল না। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে আমার দীর্ঘদিনের সহযোগী অনেকে বেকার হতেন। সেটা হতে দিতে চাইনি!”

২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল এক সন্ধেয় হুট করেই একটি ই মেল-এর মাধ্যমে পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার কথা জানতে পেরেছিলেন অপর্ণা। এর পরে অন্য নামে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে আর একটি পত্রিকা শুরু করেন তিনি। ফিউচার এডুকেশনাল রিসার্চ ট্রাস্ট নামে একটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় সেই পত্রিকাটির সঙ্গে সারদা-গোষ্ঠী প্রকাশিত পাক্ষিকটির যে কোনও সম্পর্ক নেই, তা এ দিনও দাবি করেছেন অপর্ণা। পরে প্রকাশিত পত্রিকাটিও অবশ্য এখন বন্ধ। তার মালিকানার সঙ্গে সারদার সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে ইডিও খোঁজখবর করেছে।

এই বিষয়গুলি স্পষ্ট করতেই ইডি-র দফতরে তাঁকে ডাকা হয়েছিল বলে এ দিন দাবি করেন অপর্ণা। প্রধানত, ইডি-কর্তা যোগেশ গুপ্তর ঘরে বসেই তাঁদের কথা হয়। অপর্ণা ও তাঁর স্বামী কল্যাণ রায়ের জন্য চা, জলখাবার ও মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করাও হয়েছিল। কিন্তু ছ’ঘণ্টা কেন লাগল? অপর্ণার বক্তব্য, মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠানো হয়েছিল বলে তদন্তকারীরা তাঁকে নিয়েও কিছু ক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন। এ ছাড়া, তাঁর সারদা-সংস্রব নিয়ে সবিস্তার লিখিত বিবৃতি দেন অপর্ণা। পুরোটা লিখতে সময়ও লেগেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement