কখনও প্রয়োজনের সময়ে হাত গুটিয়ে। কখনও আগ বাড়িয়ে অতি তত্পরতা। দলীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বাহিনীকে এ ভাবে পুতুল করে রেখে নিচুু তলার মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য আঙুল উঠেছে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডির দিকে, পুলিশেরই নিচু ও মাঝারি স্তর থেকে। এ জন্য ডিজি’র পদত্যাগেরও দাবি উঠেছে এই মহলে।
শনিবার ভাঙড়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ চলাকালীন পুলিশ থাকলেও কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। হিংসায় দু’জনের প্রাণ গিয়েছে। অভিযোগ, সোমবার বীরভূমের মাখড়া গ্রামে তৃণমূলের ‘গ্রাম দখল’ অভিযান ও বিজেপি-র ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ পর্বেও পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। ওখানে তিন জন নিহত হন।
পুলিশের নিচু তলার একাংশের দাবি, দু’টি ক্ষেত্রেই নবান্নের নির্দেশে আইনরক্ষকদের নিষ্ক্রিয় থাকতে হয়। শুধু তা-ই নয়, শুক্রবার পাড়ুইয়ের চৌমণ্ডলপুরে ওসি আক্রান্ত হওয়ার পরে শনিবার গ্রামের বাড়ি-বাড়ি পুলিশি হানাদারির পিছনেও শাসকদলের স্বার্থরক্ষার তাগিদ দেখছেন পুলিশেরই একাংশ। পাড়ুই থানার এক কনস্টেবলের আক্ষেপ, “মানুষের ক্ষোভের মুখে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দিয়ে যা করানো হচ্ছে, তার জন্য পরিবারের কাছেও মুখ দেখানো দায়।” মালদহের হরিশচন্দ্রপুর থানার এক কনস্টেবলও একমত। মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ফেসবুকে অশালীন মন্তব্য পোস্ট করায় এক তৃণমূল সমর্থককে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তুলেছিল সেখানকার পুলিশ, যা ঘিরে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। “শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের চোখে ভাল সাজতে পুলিশ কর্তারা আমাদের বলছেন, হাতকড়া পরাও। অথচ এ ভাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভাঙার শাস্তি হলে আমরাই তো পাব! উপরওয়ালারা তখন পাশে এসে দাঁড়াবেন না।” মন্তব্য ওই কনস্টেবলের।
এমতাবস্থায় রাজ্য পুলিশের প্রধান যিনি, সেই ডিজি’র ভূমিকাকে কাঠগড়ায় তুলে ওঁদের প্রশ্ন, “বাহিনীর এমন হেনস্থা দেখে ডিজি কেন প্রতিবাদ করছেন না? কিছু করতে না-পারলে উনি চেয়ার আঁকড়েই বা রয়েছেন কেন?” শাসকদলের আজ্ঞাবহ কাঠের পুতুলে পরিণত হওয়া বাহিনীতে ডিজি-র থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। প্রসঙ্গত, পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যায় অভিযুক্ত বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের পক্ষে ডিজি রেড্ডি ক’দিন আগে সওয়াল করে গিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টে। তখনও পুলিশের নিচু তলায় অসন্তোষের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে স্রোত প্লাবনে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তাদেরও কেউ কেউ বর্তমান পরিস্থিতির দায় ডিজি-র উপরে চাপিয়েছেন। অবশ্য ডিজি-র প্রতিক্রিয়া মেলেনি। ফোন করা হলে ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
কিন্তু পুলিশ তো চিরকালই শাসকের হয়ে কাজ করে! আগের জমানায় যেমন নন্দীগ্রামে করেছে, এখন করছে পাড়ুইয়ে বা ভাঙড়ে। এখানে প্রশ্ন উঠছে, মাখড়ায় হত তিন জনের দু’জন তৃণমূলের লোক হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তাঁদের বাঁচাতে গেল না কেন? ভাঙড়েও তো একই ব্যাপার?
নিচু মহলের ব্যাখ্যা, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা শাসকদলের কর্মী হলেও ক্ষমতাবান ছিলেন না। তাই তাঁদের বাঁচানোর দায়ও ওঁদের ছিল না। “চাকরির খাতিরে প্রভাবশালীদের স্বার্থ দেখাই পুলিশের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গেলেই মার খাচ্ছি! যে মারছে, তার কিছু হচ্ছে না!” আক্ষেপ করছেন তাঁরা। বোলপুর থানায় হামলাকারী বীরভূমের যুব তৃণমূল সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষকে যে দু’মাসেও গ্রেফতার করা হয়নি, এ প্রসঙ্গে তারও উল্লেখ করা হচ্ছে। কৃষ্ণনগরে কর্মরত পুলিশের এক নিচু তলার অফিসারের দাবি, “বাম আমলে পুলিশ সিপিএমের নির্দেশে চলত। কিন্তু পুলিশের উপরে আক্রমণ হলে কাউকে রেয়াত করা হতো না। অথচ এখন পুলিশেরই নিরাপত্তা সঙ্কটে। মনোবল তো ভাঙবেই!” বোলপুর থানার এক কনস্টেবলের তথ্য, “এক বছরে পাড়ুই থানায় তিন-তিন বার ওসি বদলেছে। নতুন ওসি এসেছেন দিন কুড়ি হল। তিনিই মার খেয়েছেন। মানুষ ওঁকে নিরপেক্ষ মনে করেনি।”
বীরভূমে পুলিশ যে শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনেই চলছে, একাধিক পুলিশকর্মীর কথায় সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। “পরপর ওসি বদলিই নয়। দু’বছরে জেলায় এসপি বদল হয়েছে তিন বার। অনুব্রতেরা এ ভাবেই ক্ষমতা রাখতে চেয়েছেন।” বলছেন ইলামবাজার থানার এক অফিসার। উল্লেখ্য, বোলপুর থানায় হামলার পর বীরভূমের বর্তমান এসপি অলোক রাজোরিয়া মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।’ যার পরিণামে তাঁরও বদলি আসন্ন বলে নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত।
তার প্রেক্ষিতে নিচু তলার প্রশ্ন, “ডিজি যদি খোদ এসপি’কেই চাকরির নিরাপত্তা দিতে না-পারেন, তা হলে তাঁর পদে থেকে কাজ কী?”