নবান্ন ঘুরে এসেই মুকুল সময় চাইলেন, জল্পনা তুঙ্গে তৃণমূলে

সিবিআইয়ের তলব পেয়ে দিল্লিতে বসে জানিয়েছিলেন তিনি অসুস্থ নন। তাঁর লুকনোরও কিছু নেই। সিবিআই যখন বলবে, তখনই তাদের মুখোমুখি হতে তৈরি। বুধবার দুপুরে কলকাতায় ফিরেও বলেন, দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিবিআইকে জানিয়ে দেবেন, কবে তাদের কাছে যাচ্ছেন। সেই মুকুল রায়ই রাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে আইনজীবী মারফত চিঠি পাঠিয়ে আর্জি জানালেন, তাঁকে অন্তত ১৫ দিন সময় দেওয়া হোক!

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর পথে। বুধবার। ছবি: শৌভিক দে।

সিবিআইয়ের তলব পেয়ে দিল্লিতে বসে জানিয়েছিলেন তিনি অসুস্থ নন। তাঁর লুকনোরও কিছু নেই। সিবিআই যখন বলবে, তখনই তাদের মুখোমুখি হতে তৈরি। বুধবার দুপুরে কলকাতায় ফিরেও বলেন, দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিবিআইকে জানিয়ে দেবেন, কবে তাদের কাছে যাচ্ছেন। সেই মুকুল রায়ই রাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে আইনজীবী মারফত চিঠি পাঠিয়ে আর্জি জানালেন, তাঁকে অন্তত ১৫ দিন সময় দেওয়া হোক!

Advertisement

সিবিআই অবশ্য তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে অত সময় দিতে রাজি হয়নি। তাদের তরফে মুকুলকে আগামী সপ্তাহের মধ্যে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মুকুলের হঠাৎ এই মত বদল কেন? কলকাতায় ফিরেই বুধবার মুকুল গিয়েছিলেন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে। প্রায় আধঘণ্টা দলনেত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে তাঁর এক সময়ের ‘বিশ্বস্ত’ সেনাপতির। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলনেত্রীর পরামর্শেই সিবিআইয়ের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আসলে মুকুল-পর্বের ধাক্কায় ঘর গোছানো এবং দলের কৌশল চূড়ান্ত করার জন্য সময় প্রয়োজন মমতারই, দাবি সেই সূত্রের।

নবান্নে আলোচনা সেরে আসার পরে আইনজীবী রাজদীপ মজুমদারের মাধ্যমে রাতে সিবিআই দফতরে চিঠি পাঠান মুকুল। তাঁর নিজের বক্তব্য, “আমি বলেছিলাম, কলকাতায় ফিরে যোগাযোগ (সিবিআইয়ের সঙ্গে) করব। যোগাযোগ স্থাপন করেছি। উপনির্বাচনের জন্য একটু সময় চেয়েছি।” তৃণমূলের এই শীর্ষ নেতার যুক্তি, বনগাঁ লোকসভা ও কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন উপলক্ষে বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে। সেই কারণেই তিনি দিন পনেরো সময় চেয়েছেন সিবিআইয়ের কাছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন, ওই দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচন হতে এখনও প্রায় এক মাস (১৩ ফেব্রুয়ারি) দেরি। ভোট যত কাছে আসবে, মুকুলের রাজনৈতিক ব্যস্ততা তখন আরও বাড়বে! তা হলে হঠাৎ এখন সময় চাওয়া কেন?

Advertisement

তৃণমূলের অন্দরের খবর, সিবিআইয়ের নোটিস মুকুলের কাছে পৌঁছনো মাত্রই মমতা বুঝতে পারছেন, জল ক্রমশ গলার উপরে উঠে আসছে! জেরায় সন্তুষ্ট না হলে সিবিআই যদি মন্ত্রী মদন মিত্রের মতো মুকুলকে কোনও ভাবে গ্রেফতার করে নেয়, তখন দলের কৌশল কী হবে? এই প্রশ্নেই এখন নানা রকম সম্ভাবনা নিয়ে জোরদার জল্পনা এবং আলোচনা চলছে শাসক দলের অভ্যন্তরে। পাশাপাশি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রবল উদ্বেগ, সিবিআইয়ের জেরায় মুকুল যদি মুখের আগল খুলে দেন, তা হলে তদন্তের হাত উঠে আসবে একেবারে শাসক দলের মাথার কাছে! ডেলোর বাংলোয় সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করে নিয়ে আতঙ্কের পারদ ইতিমধ্যেই বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী!

সেই জন্যই ঘুঁটি সাজাতে একটু সময় খুঁজছেন তৃণমূল নেত্রী।

দলের ভিতরে এর মধ্যেই প্রস্তাব উঠতে শুরু করেছে, মুকুল গ্রেফতার হয়ে গেলে আর অপেক্ষা না করে বিধানসভা ভেঙে নতুন করে জনতার রায় নেওয়া হোক। তাতে দলের গায়ে লেগে থাকা কলঙ্ক কিছুটা তুলে ফেলার সুযোগ পাওয়া যাবে। আর মুকুল-হীন পর্বে দল চালানো যেমন কঠিন হবে, তেমনই তদন্তের স্রোত ক্রমশ এগিয়ে আসবে কালীঘাটের দিকে। একেবারে সারদা-বিধ্বস্ত হয়ে ২০১৬-র নির্বাচনে যাওয়ার চেয়ে আগাম ভোট করে নেওয়া ভাল বলেই দলের একাংশের মত। নানা সম্ভাবনা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না বলেই মুকুলকে দিয়ে সিবিআইয়ের কাছে সময় চাইয়েছেন মমতা, ব্যাখ্যা ওই তৃণমূল সূত্রের।

সময় চাওয়ার পরেও অবশ্য দলের ভিতরে উদ্বেগ কমছে না! তৃণমূলের এক বিধায়কের কথায়, “দলনেত্রী হয়তো কৌশল ঠিক করার জন্য একটু সময় চাইতে পারেন। কিন্তু যাঁর জন্য সময় চাওয়া, তিনি এই সময়টা কী ভাবে কাজে লাগাবেন কেউ কি জানে?” বস্তুত, মঙ্গলবার বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের একটি দাবিকে কেন্দ্র করে এই জল্পনা আরও বেড়ে গিয়েছে। তিনি দাবি করেন, বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন মুকুল। সিবিআইয়ের নোটিস পাওয়ার পরে মুকুলের মুখে ‘চক্রান্ত-তত্ত্বে’র অনুপস্থিতি, রাহুলবাবুর দাবি এবং এখন সময় চাওয়া এই সব ঘটনার ঘনঘটা তৃণমূলের অন্দরে ফিসফাস আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রাহুলবাবু এ দিন অবশ্য খিদিরপুরে এক সভায় বলেছেন, “দিল্লিতে বিজেপি নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরে সাড়া না পাওয়ায় নবান্ন ছাড়া কোথায়ই বা যাবেন মুকুল?”

ডেলো বৈঠক নিয়ে মুখ খোলার জন্য নবান্নে অবশ্য এ দিন দলনেত্রীর প্রবল উষ্মার মুখেও পড়তে হয়েছে মুকুলকে। এ দিন দুপুরে বিমানবন্দরে নেমেই মুকুল সাংবাদিকদের সামনে ডেলো-বৈঠক নিয়ে কোনও মন্তব্য করার কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু তা দলনেত্রীর উৎকণ্ঠা কমাতে পারেনি! সিবিআইয়ের মুখোমুখি হওয়ার ঠিক আগে কেন এমন ‘অসতর্ক’ মন্তব্য করতে গেলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, জানতে চেয়েছিলেন ক্রুদ্ধ মমতা। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, মুকুল যেমন এক দিকে ওই মন্তব্য করার কথা অস্বীকার করেছেন, তেমনই দলনেত্রীর কাছে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন দলের পদ থেকে সরে যাওয়ার। তা হলে মুকুলের বিরুদ্ধে সিবিআই কোনও পদক্ষেপ করলেও দলের উপরে আনুষ্ঠানিক ভাবে তার আঁচ কম হবে। কিন্তু মমতা ওই প্রস্তাবে রাজি হননি বলেই ওই সূত্রের খবর। দলেরই এক নেতার প্রশ্ন, “পদ থেকে সরে গেলে মুকুল তো দায়মুক্ত হয়ে যাবেন! তার ঝুঁকি আরও বেশি!”

আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, পদ ছাড়া নিয়ে এমন কোনও কথাই হয়নি! বরং, অন্য একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই সংক্রান্ত বিষয়ে দলকে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “উপেনবাবু সিবিআইতে কাজ করেছেন। যখন যেমন প্রয়োজন হবে, সেইমতো উনি দলকে পরামর্শ দেবেন।” উপেনবাবুর বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। তবে পার্থবাবু এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন, “সিবিআইয়ের প্রশ্নমালার খসড়া কী ভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম?”

বিরোধীরা আবার যথারীতি মুকুল-প্রশ্নে শাসক দলের উপরে চাপ অব্যাহত রেখেছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “মুকুল রায় এখন নিজে বাঁচতে চাইছেন। অন্যকে জালে ফেলতে চাইছেন।” ডেলো-প্রসঙ্গ তুলে সূর্যবাবুর ইঙ্গিত ছিল মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই। আর কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, “মানুষ যখন ডোবে, তখন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। মুকুলও ভাবছেন, সময় নিলে হয়তো বেঁচে যাবেন!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement