প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শুক্রবার কালীঘাটের বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
রাজনীতিতে আনকোরা এক গুচ্ছ নতুন মুখকে ভোটের ময়দানে নামিয়েছেন তিনি। নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে তাঁরা যাতে দিশাহারা না হয়ে পড়েন, তার জন্য টোটকাও বেঁধে দিলেন তিনিই। শুধু দলনেত্রী নয়, একেবারে অভিভাবক সুলভ কায়দায়।
প্রবল বৃষ্টিতে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে কাকভেজা দলের নেতা-কর্মীদের যাতে ঠান্ডা না-লাগে, তার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে থাকেন, “বাড়ি গিয়ে গরম জলে স্নান করে নেবেন।” এ বার লোকসভার ভোটে রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থীদের শুক্রবার তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে ডেকে গরম মোকাবিলা থেকে জনসংযোগ, সব দাওয়াই-ই বাতলে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর বিশেষ নজর ছিল রাজনীতির আসরে অনভিজ্ঞদের প্রতি।
তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় চলচ্চিত্র তারকা থেকে ফুটবলার, বেশ কয়েক জন ‘সেলিব্রিটি’ আছেন। প্রচণ্ড গরমে তাঁদের ভোটের প্রচার করতে হবে। সে দিকে লক্ষ রেখেই এ দিন দলীয় নেতৃত্বের জন্য দিদি-সুলভ নির্দেশ জারি হয়েছে, তারকাদের সকাল থেকে প্রচারে নিয়ে বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত পর্যন্ত বেরোলেই হবে। মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, অর্পিতা ঘোষ, ইন্দ্রনীল সেন, সৌমিত্র রায়দের জন্য তাঁর টোটকা সঙ্গে এমন পানীয় রাখতে হবে, যা শরীর ঠান্ডা রাখে।
শরীর সতেজ রেখে ভোটের প্রচারের জন্য এই যদি ‘দিদি’র পরামর্শ হয়, তবে ভোটের কাজ মসৃণ ভাবে করার কৌশলও বলে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। প্রশাসনের আধিকারিক এবং এলাকার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। বৈঠকের শেষে এক প্রার্থীর বক্তব্য, “দিদি বলে দিয়েছেন, অযথা কারও সঙ্গে বিতর্কে যাবেন না। সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবেন।” আর এক প্রার্থীর কথায়, “দিদি বলেছেন, আমাদের কোনও জাত-ধর্ম-বর্ণ নেই। আমাদের একটাই আদর্শ, আমরা মানুষের স্বার্থে কাজ করব।”
অন্য ভূমিকায়। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে নির্বাচনী বৈঠক
সেরে বেরোনোর পথে মুনমুন সেন। ছবি: সুদীপ আচার্য।
পুরনো সাংসদদের সঙ্গেই নতুনদের এ দিন কালীঘাটে মমতা ডেকেছিলেন দলের জেলা সভাপতিদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। ঘাটালের প্রার্থী, অভিনেতা দেব এবং যাদবপুরের প্রার্থী, শিক্ষাবিদ সুগত বসু ছাড়া সকলেই উপস্থিত হয়েছিলেন। সুগতবাবুর বদলে অবশ্য তাঁর মা, যাদবপুরের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু বৈঠকে ছিলেন। দেব হায়দরাবাদে একটি ছবির কাজে ব্যস্ত। তিনি বৈঠকে থাকতে পারবেন না বলে আগাম নেত্রীকে জানিয়ে রেখেছিলেন বলে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি। আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রার্থীদের কী করণীয়, বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়েছেন মমতা।
বৈঠকে প্রার্থীদের হাতে নির্বাচন বিধির প্রতিলিপি তুলে দিয়ে তা ভাল করে পড়তে নতুন প্রার্থীদের নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। তাঁর সরকার এক হাজার দিনে কী কাজ করেছে, প্রচারের সুবিধার্থে তার খতিয়ানও দেওয়া হয়েছে প্রার্থীদের। ভাইচুং, মুনমুন, সন্ধ্যাদেবীর মতো রাজনীতিতে নবাগতদের আশ্বস্ত করে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, জেলা সভাপতি ও নেতারা তাঁদের প্রচার থেকে ভোটের কাজকর্ম দেখভাল করবেন। কোনও অসুবিধা হলেই প্রার্থীরা জেলা সভাপতিদের সাহায্য নেবেন। প্রচারের কর্মসূচি ঠিক করতে প্রার্থীদের নিয়ে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়, মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী পর্যায়ক্রমে জেলা কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠক করবেন। আর একেবারে নতুন প্রার্থীদের এলাকায় মমতা নিজেই প্রচারে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি জারি হয়েছে কিছু নিষেধাজ্ঞাও। দলের রাজ্য নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া সংবাদমাধ্যমে প্রার্থীদের মুখ না খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক প্রার্থীর কথায়, “নেত্রী আমাদের বলেছেন, টিভিতে মুখ দেখানোর চেয়ে জনতার দরবারে থাকুন।”
বৈঠক থেকে বেরিয়ে বাঁকুড়ার প্রার্থী মুনমুন, মেদিনীপুরের সন্ধ্যাদেবী, দার্জিলিঙের ভাইচুং, বিষ্ণুপুরের সৌমিত্র খান থেকে শুরু করে হাওড়ার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীরামপুরের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগরের তাপস পাল, বীরভূমের শতাব্দী রায়ের মতো পুরনোরাও উজ্জীবিত। প্রায় প্রত্যেকেরই বক্তব্য, “দিদি বলেছেন, আমরা যত বেশি সংখ্যায় জিতব, তত বেশি বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে দিল্লিতে জোর আওয়াজ তোলা যাবে।” গাড়িতে উঠতে উঠতে কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ছোট ভাই, রায়গঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী সত্যরঞ্জনের মন্তব্য, “দিদির মুখ আমি রাখব! আমার চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না।” বলেই দু’হাত কপালের কাছে জড়ো করে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর উক্তি, “বাকিটা তো উপরওয়ালার দয়া!”