শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, রাজ্যের নতুন নগরায়ণ-নীতি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলেও ভূবিজ্ঞানী ও ভূকম্প গবেষকদের একাংশের আশঙ্কা। তাঁরা বলছেন, কলকাতায় উঁচু বহুতল গড়ার ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না-হলে সামান্য ভূমিকম্পেই সেগুলি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের সঙ্গে জোট বেঁধে কলকাতা ও তার আশপাশে ৪০০ বর্গকিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে ভূকম্পপ্রবণ এলাকাগুলি চিহ্নিত করেছে খড়্গপুর আইআইটি। ওই সব এলাকায় মাটির নীচে কী ধরনের পাত রয়েছে, কোন এলাকার মাটির চরিত্র কেমন এ সব খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। ভূমিকম্প হলে কোথায় ভূস্তর কাঁপতে পারে, তা খুঁজে বার করে মহানগরীর কোথায় কেমন বাড়ি হতে পারে, সেটাও সমীক্ষা করে দেখছেন আইআইটি-র গবেষকেরা।
ভূকম্প-প্রবণ অঞ্চল।
সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।
ওই গবেষকদলের প্রধান বিজ্ঞানী শঙ্করকুমার নাথ বুধবার জানান, মহানগরীর কোন এলাকায় কী ধরনের বাড়ি তৈরি করা যাবে, কোথায় কী কী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নির্মাণে কী কী সামগ্রী ব্যবহার করা যাবে— এ সব নিয়েই সমীক্ষা করেছেন তাঁরা। কলকাতার জন্য ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন একটি ভূকম্প-মানচিত্রও। “ওই সমীক্ষা থেকে পরিষ্কার, নির্দিষ্ট এলাকার জন্য নির্দিষ্ট সতর্কতা-বিধি না মেনে বহুতল গড়লে তা কলকাতায় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”—মন্তব্য শঙ্করবাবুর। কেন?
খড়্গপুর আইআইটি-র ওই বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা, সামান্য কম্পনে দুটো বাড়ি একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খাবে কি না, তা নির্ভর করে ওই এলাকার ভূস্তরের উপরে। কারণ, ভূস্তরে সব সময়ে কম্পন চলছে। তাই বিভিন্ন বহুতলও কাঁপছে। কিন্তু দু’টি কম্পনের মাত্রা আলাদা। যদি ভূস্তর ও বহুতল, দু’টোর দুলুনির মাত্রাই এক হয়ে যায়, তা হলে অতি অল্প মাত্রার ভূকম্পেই (রিখটার স্কেলে ৩-৪) পেল্লায় মাপের বহুতল ভেঙে পড়তে পারে। যেমন, ১২তলা বাড়ি হলে সাধারণত তার কম্পাঙ্ক হয় ১.২ হার্জ। ওই এলাকার ভূস্তরের দোলার ছন্দও যদি ওই একই মাত্রায় হয়, তবে রিখটার স্কেলে ৩-৪ মাত্রার ভূমিকম্পেও ওই বহুতল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী জ্ঞানরঞ্জন কয়ালও বলেন, “কলকাতার সব জায়গায় ভূস্তরের অবস্থা এক নয়। ভূস্তরের অবস্থা বুঝে বাড়ি তৈরির নীতি তৈরি করতে হবে রাজ্য সরকারকে। না হলে সমূহ বিপদ।”
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে নতুন নগরায়ণ-নীতি তৈরির করার ক্ষেত্রে ভূকম্প-বিশারদ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। তা না-হলে ভূকম্পের সময়ে বড় বিপদের মুখে পড়তে পারে মহানগর। কিন্তু কলকাতা কিংবা তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কতটা?
ভূবিজ্ঞানীদের সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গ কিন্তু মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের শিকার হতেই পারে (রিখটার স্কেলে ৫-৬.৯)। খড়্গপুর আইআইটি-র এক ভূবিজ্ঞানী জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় (অবিভক্ত বাংলা) মাটির সাড়ে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার নীচে একটি খাত (ইয়োসিন হিঞ্জ) রয়েছে। সেই খাত থেকে মাঝেমধ্যেই কম্পন তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ওই খাতের বিভিন্ন অংশ থেকে ৫.৪, ৫.৬ মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে। “সেখান থেকে সর্বোচ্চ ৬.৮ তীব্রতার ভূমিকম্প তৈরি হতে পারে।”— মন্তব্য ওই বিজ্ঞানীর।
তবে ওই মাত্রার ভূমিকম্প কবে হবে, তার উৎসকেন্দ্র ঠিক কোথায় হবে, সে ব্যাপারে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান খড়্গপুরের ভূবিজ্ঞানীরা। তাঁদের ব্যাখ্যা, যে ভাবে যত্রতত্র মাটির নীচ থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে এবং জলাভূমি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে, তাতে কলকাতায় ভূস্তরের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তাই মাঝারি মানের কোনও ভূমিকম্পই (উৎসকেন্দ্র কলকাতার কাছাকাছি হলে) মহানগরীর বিপদ ঘটাতে পারে।
শুধু কলকাতা নয়, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতেও যেখানে-সেখানে বহুতল গড়া বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ২০১১ সালের সিকিমের ভূকম্পের পরে তার ইঙ্গিতও মিলেছে বলে ভূবিজ্ঞানীদের দাবি। তাঁরা বলছেন, ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সিকিমে ৬.৯ মাত্রার ভূকম্প হয়েছিল। তার প্রভাবে শিলিগুড়িতে মাটি ফেটে গিয়েছিল। সেতুতেও ফাটল ধরেছিল। ওই ভূকম্পের পরে সিকিম ও উত্তরবঙ্গে সমীক্ষা করেছিল শঙ্করবাবুর নেতৃত্বাধীন খড়্গপুর আইআইটি-র একটি দল। শঙ্করবাবু বলেন, “শিলিগুড়ির এই পরিস্থিতির কথা আমরা রাজ্য সরকারকে তখনই জানিয়েছিলাম।”