স্বপন দেবনাথ ও মলয় ঘটক
পঞ্চায়েত দফতরের চারশো পদে নিয়োগের জন্য বর্ধমান জেলা জুড়ে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু উত্তীর্ণের তালিকায় শিল্পাঞ্চলের প্রার্থীদের নাম নেই বললেই চলে।
এর মধ্যে পঞ্চায়েত সহায়ক পদের জন্য যে ৮২০ জনের নাম বেরিয়েছে, তার মধ্যে শিল্পাঞ্চলের এক জনও নেই। ইতিমধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ বিধানসভা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, রাজ্যের দুই মন্ত্রীর ক্ষমতার লড়াই এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছে বলে তৃণমূলেরই একাংশের দাবি।
এঁদের এক জন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প তথা প্রাণিসম্পদ দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ)-ও তিনি এবং গোটা ঘটনায় তাঁর হাত রয়েছে বলে রাজ্যস্তরে নালিশ করা হয়েছে। যাঁরা নালিশ করেছেন, তাঁদের অনেকেই শ্রমমন্ত্রী তথা দলের জেলা শিল্পাঞ্চল সভাপতি মলয় ঘটকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আজ, মঙ্গলবার এঁদের একটি দল কলকাতায় গিয়ে তৃণমূলের অন্যতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে লিখিত অভিযোগ জানাবেন বলেও ঠিক রয়েছে।
বর্ধমানে পঞ্চায়েত স্তরে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে সোমবারই বিধানসভায় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, দুর্নীতিতে এক মন্ত্রী, নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান এবং জেলা সভাধিপতি জড়িত বলে তৃণমূলের লোকেরাই সন্দেহ করছেন। মন্তেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক মহম্মদ হেদায়েতুল্লাও একই দাবি তোলেন।
কিন্তু বিরোধীদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্ত তৃণমূলের জেলা নেতাদের একটা বড় অংশই। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, জেলা পরিষদের অনেক কর্মাধ্যক্ষই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের তালিকায় নিজেদের পছন্দের নাম ঢোকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের আমল না দিয়ে তিন নেতা নিজেদের মর্জিমাফিক তালিকা প্রকাশ করেছেন। শিল্পাঞ্চল থেকে আসা জেলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী প্রিয়া সূত্রধর জেলাশাসকের কাছে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, “শিল্পাঞ্চলে কি এক জনও যোগ্য প্রার্থী ছিল না?”
এই নিয়ে তুমুল হইচই হওয়ায় জরুরি সভা ডাকা হয়। সেখানে জেলা সভাধিপতি দেবু টুডুর কৈফিয়ত দাবি করা হয়। তাঁর উত্তরে অনেকেই তুষ্ট হতে পারেননি। শেষমেশ রাজ্য নেতৃত্বের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই দলে যাঁরা আছেন, সেই গোলাম জার্জিস, নারায়ণ হাজরা চৌধুরী, নুরুল হাসান, গার্গী নাহা, চন্দনা সামন্ত, বিকাশ চৌধুরী, রুবী ধীবরেরা জেলার রাজনীতিতে মলয়-শিবিরের লোক বলে পরিচিত। স্বপন দেবনাথ, দেবু টুডু ও জেলা নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান উজ্জ্বল প্রামাণিক ‘চক্র’ গড়ে তালিকা প্রকাশ করেছেন বলে তাঁরা অভিযোগ করতে পারেন। ওই তালিকা বাতিল করা বা পরের ধাপে যে মৌখিক পরীক্ষার কথা তাতে আরও বেশি পরীক্ষার্থীকে বসার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাতে পারেন তাঁরা।
স্বপন-শিবিরের কটাক্ষ, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ‘টেট’ পরীক্ষার মতো এই পরীক্ষাতেও চাকরি পাইয়ে দেবেন বলে কেউ-কেউ পরীক্ষার্থীদের থেকে টাকা নিয়েছিলেন। তার পরে তালিকায় নাম তোলাতে না পেরে চাপে পড়ে যান। তাই তালিকা বাতিল করাতে না পারলে মৌখিকে বাড়তি প্রার্থী ঢোকানোর চেষ্টা করছেন। স্বপন-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত উজ্জ্বলবাবুর দাবি, “স্বচ্ছতা রেখে, নিয়ম মেনে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে।” স্বপনবাবু বলেন, “আমি পরীক্ষার মধ্যে নেই। তাই কী হয়েছে তা বলতে পারব না। আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতেই পারেন, তবে চক্রান্ত চলছে কি না তা-ও বলতে পারব না।”
শুধু ওই পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েই যে মলয়-শিবির ক্ষান্ত হবে, এমনটা না-ও হতে পারে। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, জেলার গ্রামীণ এলাকায় তৃণমূল সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়েছে বলেও রাজ্য নেতৃত্বকে জানানো হতে পারে। মলয়-অনুগামী কিছু কর্মাধ্যক্ষ বলেন, “আমাদের অনেকেই জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক। অথচ স্বপনবাবু আমাদের ডাকার প্রয়োজন বোধ করেন না। উনি দু’জনকে নিয়ে দল চালাচ্ছেন। তিন বছরে জেলা কমিটির বৈঠক পর্যন্ত করেননি। শীর্ষ নেতৃত্বকে জানাব।”
শিল্পাঞ্চল থেকে জিতে মন্ত্রী হওয়া মলয় ঘটক অবশ্য কোনও বিষয়েই কোনও মন্তব্য করতে চাননি।