নেতা অধরা, ভয়ে কাঁটা পুলিশই

থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর অভিযোগ এনেছিল পুলিশ নিজেই। ঘটনাটা বুধবার রাতে ঘটলেও এফআইআর দায়ের করতে লেগেছিল গোটা একটা দিন। পুলিশের নিচুতলায় ক্ষোভের আঁচ পেয়ে খোদ ডিজি নড়ে বসার পর বৃহস্পতিবার রাতে দায়ের হয়েছিল অভিযোগ। তার পর আরও ২৪ ঘণ্টা পার। এখনও ধরা যায়নি বীরভূম জেলা তৃণমূলের যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ এবং তাঁর ৯ সঙ্গীকে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:০০
Share:

থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর অভিযোগ এনেছিল পুলিশ নিজেই। ঘটনাটা বুধবার রাতে ঘটলেও এফআইআর দায়ের করতে লেগেছিল গোটা একটা দিন। পুলিশের নিচুতলায় ক্ষোভের আঁচ পেয়ে খোদ ডিজি নড়ে বসার পর বৃহস্পতিবার রাতে দায়ের হয়েছিল অভিযোগ। তার পর আরও ২৪ ঘণ্টা পার। এখনও ধরা যায়নি বীরভূম জেলা তৃণমূলের যুব সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ এবং তাঁর ৯ সঙ্গীকে। বরং বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ ওই নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার পর বোলপুর পুলিশ লাইনের অফিসারদের একাংশই ভয়ে ভয়ে রয়েছেন।

Advertisement

বোলপুর থানার এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার পরে এখন বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে থানার আবাসনে থাকতেও ভয় পাচ্ছি। ইতিমধ্যেই এফআইআরের অভিযোগ হাল্কা করার জন্য চাপ আসছে। এখানে আমাদের লোকবল কম। কেউ এসে হামলা করলে কিছু করার থাকবে না।”

এই অবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ শোনাচ্ছে বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার মন্তব্য। তাঁর কথায়, “এটুকু বলতে পারি, পুলিশ খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই মিলে এর মোকাবিলা করব।”

Advertisement

বস্তুত, শাসক দলের নেতা হলে পুলিশ পিটিয়েও পার পাওয়া যায় এই বার্তা নিচু তলায় যে পৌঁছে গিয়েছে, জেলার পুলিশকর্তারা তা বেশ বুঝতে পারছেন। সাগর ঘোষ খুনের মামলায় এফআইআরে নাম থাকা সত্ত্বেও গত এক বছরে ধরা যায়নি অনুব্রতকে। প্রকাশ্য সভায় পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দেওয়ার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। উল্টে অনুব্রতকে এক মঞ্চে নিয়ে সভা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুদীপ্তর বিরুদ্ধে বুধবার রাতে মদ্যপ অবস্থায় দলবল নিয়ে বোলপুর থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা এখনও অধরা থাকায় ক্ষুদ্ধ পুলিশের নিচুতলা।

বোলপুর পুলিশ লাইনের একাধিক পুলিশকর্মীর অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপেই সুদীপ্ত ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে বৃহস্পতিবার সারা দিন কেটে গিয়েছিল। এখনও সেই রাজনৈতিক চাপেই ধরা হচ্ছে না তাঁদের। এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “অমিত চক্রবর্তী (বোমায় নিহত দুবরাজপুরের প্রাক্তন টাউনবাবু)-র হামলাকারীদের ধরতে পারলাম না। এখন থানায় এসে আমাদের মেরে যাওয়ার পরেও আমরা হাত গুটিয়ে বসে আছি।” আর এক পুলিশকর্মীর আক্ষেপ, “আমাদের থানায় ঢুকে আমাদেরই মেরে গেল, অথচ আমরা তা হজম করে নিলাম। এক জনকেও ধরতে পারলাম না। ঘরে-বাইরে মুখ দেখানো যাচ্ছে না। এর পরে আমাদের মনোবল বলে কিছু থাকবে?”

বীরভূমের এসপি অবশ্য বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ার কথা মানতে চাননি। তাঁর কথায়, “এই ধরনের ঘটনা যে কখনও ঘটবে না, এমন বলা যায় না। তবে আমি মনে করি না এর ফলে পুলিশের মনোবল ভাঙছে। কারণ, পুলিশ হাত গুটিয়ে নেই।” পুলিশ যদি হাত গুটিয়ে বসে না-ই থাকে, তা হলে অভিযুক্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করা গেল না কেন? এসপি-র উত্তর, “তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখেই পদক্ষেপ করব।”

বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে দাড়িয়ে পাড়ুই মামলা থেকে অনুব্রতকে পুরোপুরি রেহাই দিয়েছেন ডিজি জিএমপি রেড্ডি। সুদীপ্তদের কেন গ্রেফতার করা হল না, তা জানার চেষ্টা হয়েছিল ডিজি-র কাছ থেকে। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা তিনি বলেন, “এফআইআর যখন হয়েছে, তখন অ্যাকশন নেওয়া উচিত।” তা হলে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করল না কেন? স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “আমি ঠিক জানি না। তবে খোঁজ নেব।”

এই অবস্থায় বীরভূমের পুলিশ সুপারের মন্তব্য যে যথাযথ, তা মেনে নিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার নিরুপম সোম। তিনি বলেন, “থানার মধ্যে ঢুকে যদি পুলিশকে মারধর করা হয়, তা হলে বুঝতে হবে খুবই খারাপ অবস্থা। যা এসপি স্বীকার করে নিয়েছেন। আসল এবং খাঁটি কথা এসপি বলে দিয়েছেন।” এই অবস্থা থেকে পুলিশকে বের করে আনার উপায় আইজি-ডিআইজি-দেরই খুঁজতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নিরুপমবাবু। রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি, অধুনা

বিজেপি নেতা রঞ্জিতকুমার মহান্তির ব্যাখ্যা, “এসপি অবস্থাটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু স্পষ্ট করে বলার সাহস পাচ্ছেন না।”

যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি ছাড়া আরও একটি পরিচয় রয়েছে সুদীপ্তর। তিনি বোলপুর পুরসভার নিকাশি আধিকারিক। সুদীপ্তকে নিয়ে বোলপুর পুরসভাও কিন্তু চুপ। পুরসভার এক অফিসার বলেন, “পুলিশ সুদীপ্তকে গ্রেফতার করলে এবং তাঁর হাজতবাস হলে তবেই পুরসভা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।”

জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব আগেই যুব নেতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক যেমন সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডে অনুব্রত-যোগ কিংবা নানুরে তিন ভাইয়ের খুনের ঘটনায় তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের জড়িত থাকার কথা এত দিন উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন তাঁরা। মমতার মঞ্চে ঠাঁই পেয়েছেন মনিরুলও। দিন যত এগিয়েছে, বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের অসহায়তাও তত প্রকট হয়েছে। দুবরাজপুর থানার টাউনবাবু অমিত চক্রবর্তীকে খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত, দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের শেখ আলিমকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। সম্প্রতি খয়রাশোলের লোকপুর ফাঁড়িতে চড়াও হয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ফাঁড়ি ইন-চার্জকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। একাধিক ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। কিন্তু মূল অভিযুক্তদের ছুঁতে পারেনি পুলিশ। জেলায় অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার জন্য সম্প্রতি দলের নেতা-কর্মীদের বার্তা দিয়েছিলেন জেলা সভাপতি। খারাপ আচরণ করলে শাস্তির কথাও বলেছিলেন। সুদীপ্তর ঘটনায় এখন অনুব্রত কেন চুপ, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী গোষ্ঠীর নেতারা। এ দিন অনুব্রতকে ফোন করা হলে “মিটিংয়ে আছি, পরে কথা বলব” বলেই ফোন কেটে দেন তিনি। সারাদিন বোলপুরে দেখা যায়নি সুদীপ্তকেও। পার্টি অফিসে ছিলেন না তিনি। বাড়িতে গেলে ভেতর থেকে বলা হয়, সুদীপ্ত নেই। সারাদিন ‘নট রিচেবল’ ছিল তাঁর ফোন।

তাতে অবশ্য সাধারণ পুলিশকর্মীরা বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত নন। মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা যাঁদের, শাসক দলের দুষ্কৃতীদের ভয়ে তাঁরাই পারলে নিরাপত্তা চেয়ে বসেন।

সত্যি সত্যিই পুলিশের এখন বড় কঠিন সময়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement