পাশাপাশি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার যুবভারতীতে।—নিজস্ব চিত্র।
উল্টোডাঙা থেকে সায়েন্স সিটি পর্যন্ত ইএম বাইপাসের চেহারাটাই এ দিন ছিল আলাদা। বুলেভার্ড নীল-সাদা। পরমা আইল্যান্ডের কাছে বসেছে ফুলের টব, পাতাবাহার। প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে পেল্লায় পেল্লায় পোস্টার ঝুলছে হাসছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে আবার আঁকা তিরবেগে ধাবমান বাংলার বৃদ্ধির হার।
আজ পুলিশ টানটান। অফিস টাইমেও গাড়ির জটলা নেই বাইপাসে। বেঙ্গল কেমিক্যাল, কাদাপাড়া, বিল্ডিং মোড়, চিংড়িঘাটার প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যাল যেন এ দিন অতি-সতর্ক। নিয়ম মেনে তার রঙ বদলাচ্ছে লাল-হলুদ-সবুজ। একের পর এক গাড়ি ঢুকছে সল্টলেক স্টেডিয়াম চত্বরে। শুরু হচ্ছে ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’।
বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন লাগোয়া মাঠটাকে এ দিন আপনি সহজে চিনতে পারতেন না। ঝলমলে তার বাহার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির ঘড়ির কাঁটা ধরে। এসে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও। বোঝা যাচ্ছে, আরও অনেকে এসেছেন। শিল্পের রথে বাংলা কী ভাবে এগোবে, পরবর্তী প্রহরগুলিতে সেই বার্তা দিতে। কারা আসছেন এ নিয়ে সম্মেলনের ২৪ ঘণ্টা আগেও চরম গোপনীয়তা বজায় রেখেছিলেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। সম্মেলনের দু’দিন আগে এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “আর তো কয়েক ঘণ্টা। একটু অপেক্ষা করুন না। সব দেখতে পাবেন।”
বুধবার ছিল সেই ‘সব দেখতে’ পাওয়ার দিন। কলকাতার মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের এ রাজ্যের প্রতি আস্থা জানানোর দিন। কিন্তু সম্মেলনের প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেল। মঞ্চে সকলকে ডাকাও হয়ে গেল। যাঁদের জন্য ‘আসল’ প্রতীক্ষা, তাঁরা কোথায়?
বণিকসভার এক কর্তার ঝাঁঝালো জবাব, “আপনাদের চোখ নেই। ওই তো আদি গোদরেজ বসে আছেন। ওই তো নয়না লাল কিদোয়াই আছেন। ওই তো সিদ্ধার্থ বিড়লা। যোগী দেবেশ্বর, স্বাতী পিরামল, সঞ্জীব গোয়েন্কাকেও তো দেখতে পাচ্ছি।” কিন্তু অম্বানী ভাইদের তো দেখছি না? জিন্দল, মুঞ্জাল, মহীন্দ্রা-রা কই? উইপ্রো, ইনফোসিস, আইবিএম-এর কাউকেও তো দেখা যাচ্ছে না! এই ফাঁকে এক জন প্রশ্ন ছুড়লেন, “আচ্ছা স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারপার্সন (যিনি আবার খাঁটি বাঙালি) এসেছেন?” বণিকসভার কর্তাটি এতক্ষণে জানালেন যাঁদের দেখা যাচ্ছে না, তাঁরা কেউই আসেননি। বেয়াদপ সাংবাদিকদের সঙ্গ এড়িয়ে চটপট বিদায় নিলেন তিনি। তবে যাওয়ার আগে দেখিয়ে গেলেন, “ওই দেখুন, বাঁকুড়ার এমপি।” শিল্পপতিদের সারিতে বসে তৃণমূল সাংসদ মুনমুন সেন।
বিদেশি অভ্যাগতদের ভিড় কেমন? মঞ্চে ইউকে-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন প্যাট্রিসিয়া হিউইট। রয়েছেন মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পোরেশনের সিইও। বাকিরা কারা? এক আমলা বললেন, “বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। কে কোন জন, তা বোঝানোর জন্য তো আলাদা পরিচয়পর্ব করতে হয়! লিখে নিন, ১৯টি দেশের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি এসেছেন।”
ব্রিটেন, জাপান না হয় হল। আর কোন কোন দেশ? নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর?
মাত্র ক’দিন পরেই নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের শিল্প সম্মেলনে উড়ে আসছেন খোদ মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি। আমেরিকা সেই ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ সম্মেলনের অন্যতম ‘পার্টনার’ দেশ। অথচ কলকাতার রাজকীয় শিল্প সম্মেলনের প্রথম দিনে কোনও মার্কিন প্রতিনিধিকেই দেখা গেল না। নিদেনপক্ষে স্থানীয় কনস্যুলেটের প্রতিনিধিত্ব তো থাকবে! পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কলকাতা-স্থিত মার্কিন কনসাল জেনারেল হেলেন লাফেভ মঙ্গলবার রাতে ইকো পার্কের নৈশভোজে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন মূল শিল্প সম্মেলনে আর থাকতে পারেননি। আজ, বৃহস্পতিবারও তিনি অন্য কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকবেন। তবে কনস্যুলেটের রাজনীতি এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভাগের জনৈক কর্তা গৌরব বনশল এসেছিলেন।
কে এলেন, কে-ই বা এলেন না সে সব হিসেব আরও গুলিয়ে গেল সম্মেলন কক্ষে ঢুকে। না-ই বা থাকুক মহাতারকার ভিড়, ঘর কিন্তু কানায় কানায় ভর্তি। আড়াই দিনে পাঁচ হাজার জনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে শিল্প উন্নয়ন নিগম। কারা এঁরা? প্রশ্নটা ছিল এক সিনিয়র আমলার কাছে? মুচকি হেসে তাঁর ছোট্ট জবাব, “ক্ষুদ্র-মাঝারি। ভাই একটু এক্সপ্লোর করুন।”
‘এক্সপ্লোর’ করে জানা গেল, মূলত ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পোদ্যোগীরাই সম্মেলন কক্ষ ভরিয়েছেন। মুড়ি মিল, চিঁড়ে মিল, লেদ কারখানা, ফাউন্ড্রি, প্লাস্টিক কারখানা, ট্যানারি চালিয়ে যাঁরা গ্রামাঞ্চলে প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, তাঁরাই এই ‘গ্লোবাল’ আসরের সিংহভাগ। আজ বৃহস্পতিবার তাঁদের নিয়েই বসছে বিশেষ সম্মেলন। বিদেশি প্রতিনিধি যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মুখোমুখি সরকার বসিয়ে দিতে চায় এ রাজ্যের ছোট শিল্পোদ্যোগীদের। সে জন্য দু’একটি বণিকসভাকে বাড়তি দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে।
অপ্রিয় প্রশ্নটা করেই ফেলা গেল। রাজ্যের ‘বড় শিল্পের’ ঝুলিতে কী উপহার আসছে এই সম্মেলন থেকে?
শিল্প দফতরের এক কর্তা পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, “সাগর দ্বীপে ‘ভোর-সাগর’ বন্দর হল, দুর্গাপুরে সেলের প্রায় ৪০০০ একর জমি আধুনিকীকরণের ছাড়পত্র পেল, পাঁচামি দেউচা খনি-চুক্তি হল, কলকাতার নিজস্ব নাগরদোলা (কলকাতা-আই) হল, ঝড়খালিতে ক্লাব-মহীন্দ্রার বিনিয়োগ হল এ সব কি কিছুই নয়?” কর্তার এই যুক্তি শুনে সাংবাদিকের কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে, তাঁর দেওয়া প্রকল্প-তালিকার মধ্যে ঠিক কোনটা এই ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’ থেকে উঠে এসেছে? প্রতিটি প্রকল্প নিয়েই বহু দিন ধরে চর্চা চলছে কিনা! চটজলদি প্রসঙ্গ এড়িয়ে কর্তাটির মশকরা, “আপনাদের জন্য জয়নগরের মোয়া আনিয়েছি। চেখে দেখুন, তার পর দেখবেন সব ভাল দেখছেন, ভাল শুনছেন, ভাল বলছেন।”
কেমন ভাল, দেখতে ঢোকা গেল সম্মেলনের মূল প্রদর্শনী কক্ষে। নিগম ৭৫টি স্টল দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সে সব ভরভরন্ত। সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত সরকারি পুস্তিকায় রাজ্যে যে সমস্ত সংস্থার বড় বিনিয়োগের কথা সগর্বে ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের অনেকের স্টলই চোখে পড়েনি। বরং কোথাও কম সময়ে চিংড়ির সাইজ বাড়ানোর পুষ্টিবর্ধক খাবারের স্টল তো কোথাও শান্তিপুরী শাড়ি। কোথাও কয়লা কোম্পানির স্টলে দু’চার জন সুদর্শনা, তো কোথাও সরকারি ফুডপার্কের স্টলে আলুভাজার সহজপাঠ দেখানো চলছে টিভিতে। আটা-ময়দার স্টলও দেখা গেল। সুন্দরবনের মধু চান? পাবেন। খাঁটি নেপালি মাফলারও পাবেন। সে সব দেখতে মুখ্যমন্ত্রীও এক চক্কর কেটেছেন।
আর আছে ‘বিশ্ব-বাংলা’-র দুই ‘ব’। যে দিকেই তাকান, মুখ্যমন্ত্রী-কৃত সেই লোগো-র গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দু’টি ব-এর একটির মানে ‘বিউটিফুল’, অন্যটি ‘বেঙ্গল’। সারা দিন তিনি ছিলেন সম্মেলন স্থলে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, আজ সারা দিন কোন ঘটনায় আপনি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন? মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিলেন, “আপনাদের দেখে। এ রাজ্যের জন্য একটু ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে এগোন। মনটা ভাল হয়ে যাবে।”
মন ভাল করার নানা টোটকাও অবশ্য সম্মেলনে থাকছে। বিকেলে ভাঙা হাটে লোক টানতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ঘোষণা করলেন, “সন্ধ্যায় রাশিদ খান শুনতে সবাই আসুন। আমরা একটা মনোরম সঙ্গীত-সন্ধ্যা উপভোগ করব।”
যা শুনে এক বাণিজ্য প্রতিনিধির সংযোজন, “দেখেছেন, টোটাল শিল্প হচ্ছে। সন্ধ্যায় সঙ্গীত শিল্পও থাকছে।”