বোলপুর সার্কিট হাউসে নিহত শেখ সোলেমানের পরিবারের সঙ্গে মুকুল রায়।
মাখড়ায় সংঘর্ষে নিহতদের নিয়ে বিজেপি ‘রাজনীতি’ করায় তীব্র নিন্দা করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। শুক্রবার বোলপুরে সার্কিট হাউসে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মানুষ মারা গিয়েছে। এর অন্য কোনও পরিচয় নেই। মৃত্যু নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়।”
বস্তুত, মাখড়ায় গত সোমবার বিজেপি-তৃণমূলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে বিজেপি, কংগ্রেস এবং বামেদের প্রতিনিধিদল এলাকায় গিয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি থাকার যুক্তি দেখিয়ে ওই প্রতিনিধিদলকে পুলিশ আটকেও দিয়েছে। কিন্তু, এত বড় ঘটনার পরেও শাসকদলের তরফে কোনও শীর্ষ নেতা বীরভূমে আসেননি। সেই হিসাবে মুকুলবাবুই প্রথম এলেন মাখড়া-কাণ্ডের পরে। এ দিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ বোলপুরের সার্কিট হাউসে আসেন মুকুলবাবু। উপস্থিত ছিলেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, দলের একাধিক বিধায়ক এবং এই জেলা থেকে নির্বাচিত রাজ্যের দুই মন্ত্রী। বোলপুরে আসা প্রসঙ্গে মুকুলবাবু বলেন, “আগামী ২৮ নভেম্বর পাঁচটা জেলা (তার মধ্যে রয়েছে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া) নিয়ে দুর্গাপুরে আমাদের সভা হবে। সেই সভা নিয়ে আলোচনা করতে বোলপুরে আসা।” তাঁর দাবি, “রাজ্যে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাকে সামনে রেখে বিগত সাড়ে তিন বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন সরকার যে কাজ করেছে, তার প্রতি বাংলার মানুষ পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। দল সব সময়ে কর্মীদের পাশে আছে। তৃণমূল কংগ্রেস একটি পরিবারের মতো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিভাবক।”
মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসছেন জাফারুল ইসলাম।
এ দিন সন্ধ্যায় তৃণমূলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি তথা বীরভূম জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ জাফারুল ইসলামের নেতৃত্বে এগারো জন মুকুলের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। এসেছিলেন মাখড়া গ্রামে নিহত সালুঞ্চি গ্রামের শেখ সোলেমানের পরিবারের লোকজনও। নিহত বিজেপি সমর্থক শেখ তৌসিফ আলির পরিবারের দায়ের করা লিখিত অভিযোগে জাফারুলের নাম রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে মুকুল রায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এখানে এসেছি, নিহত ও আহত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। দল সব সময়ে তাঁদের পাশে রয়েছে। ১৪৪ ধারা থাকায় ওই এলাকায় গিয়ে দেখা করা সম্ভব নয়। তাই এখানে দেখা করলাম।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, মাখড়া-কাণ্ডে কেন পুলিশ তাঁদেরই দলের কর্মী-সমর্থকদের বেশি ধরছে, তা নিয়ে মুকুলবাবুর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জেলা তৃণমূলের একাংশ। তাঁরা অভিযোগ করেন, পুলিশ এক তরফা তৃণমূলের লোকেদের ধরছে। তাতে অনেক নিরীহও গ্রেফতার হচ্ছেন। তৃণমূলের শাসনেই এই ঘটনা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ঘটনা হল, মাখড়া-কাণ্ডে পুলিশ যে ১৭ জনকে ধরেছে, তাদের মধ্যে শাসকদলের লোকই অধিকাংশ। দল সূত্রের খবর, মুকুলবাবু নেতা-কর্মীদের আশ্বাস দিয়েছেন সাধারণ ও নির্দোষরা যেন শাস্তি না পায়, সেটা তিনি দেখবেন। এর পরে তিনি বোলপুরে দলীয় কার্যালয়ে যান বৈঠক করতে।
এর পরেই তিনি সংঘর্ষে নিহতদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত, মাখড়ায় নিহত তৃণমূল কর্মী শেখ মোজাম্মেলকেও নিজেদের দলের ‘শহিদ’ হিসাবে পরিচয় দিয়ে সিউড়িতে ধর্নামঞ্চে পোস্টার সেঁটেছিলেন বিজেপি-র জেলা নেতৃত্ব। সেই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে অস্বস্তিতে পড়ে পোস্টারটি সরিয়ে দেওয়া হয়। তৃণমূলের নেতারা বলেছিলেন, “নিহতদের নিয়ে বিজেপি নোংরা রাজনীতি করছে।” এ দিন মুকুলবাবুর মন্তব্য সেই ঘটনার প্রেক্ষিতেই বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি-র জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের কটাক্ষ, “রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে তৃণমূল। এখন ওঁদের মুখে এ সব শোভা পায় না! শাসক দল হিসেবে এলাকায় অশান্তি করছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। তা ছাড়া, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা আমাদের দলের নীতি নয়।”
মুকুলবাবু এ দিন এ-ও দাবি করেছেন, “আমরা পর পর কয়েকটা নির্বাচন দেখলাম। সদ্য দেড় মাসও হয়নি, দু’টি উপনির্বাচন দেখলাম। সেই উপনির্বাচনে বাংলার মানুষ কী রায় দিয়েছেন? বাংলার মানুষ বলছেন, যে তাঁরা শান্তিতে আছেন। বাংলার উন্নয়ন হচ্ছে। তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন এই সরকার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ৩ নভেম্বর বোলপুর-পুরন্দরপুর সড়কে নব নির্মিত শাল সেতুর শুভ উদ্বোধন করার কথা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার জন্য পূর্ত দফতর সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েছিল। অথচ এ দিনই বোলপুর-সিউড়ি রাস্তার ওপর একাধিক জায়গায় লাগানো ওই তোরণ খুলে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতর। কেন পূর্ত দফতর এটা করল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে এলাকায়।
ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী।