হুদহুদের মতোই সারদা এবং বর্ধমান-কান্ডের জোড়া ধাক্কায় তৃণমূল অন্দরে ‘অ-মুকুলায়নে’র প্রক্রিয়া আরও গতি পেল।
দলের যাবতীয় সাংগঠনিক দায় দায়িত্বে এত দিন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সামলেছেন মুকুল রায়। ইতিমধ্যেই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সেই দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে। পাশাপাশি সারদা এবং বর্ধমান কাণ্ডের প্রেক্ষিতে যে কঠিন সময়ের মুখে দল পড়েছে, সেই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের তরফে মুখ খোলার দায়িত্বও এ বার দেওয়া হয়েছে পার্থবাবুকেই। স্বয়ং মুকুলই শনিবার রাতে বলেছেন, “এ বার থেকে দলের তরফে কিছু বলার থাকলে তৃণমূলের মুখপাত্র হিসেবে পার্থবাবুই বলবেন।” পার্থবাবু অবশ্য এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত পুরোদমে শুরু হওয়ার পর থেকেই দলনেত্রীর আস্থা মুকুলের উপর থেকে অনেকেটাই টলে গিয়েছে। তাঁর পরিবর্তে সংগঠনের পুরোভাগে দলনেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আর পার্থ-সুব্রত জুটির সঙ্গে অভিষেকের মসৃণ সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই মমতা মুকুলের ডানা ছেঁটেছেন বলে দলের একাংশের অভিমত। তাঁদের কথায়, “এ বার দলে মুকুল যুগের অবসানের শুরু।” অবশ্য দলে মুকুল অনুগামীদের অভিমত, সংগঠনকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যেই দলনেত্রী এই বিন্যাস করেছেন। এমনকী মুকুল নিজেও জানিয়েছেন, এ দিন সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনার জন্য দলনেত্রী তাঁকে নবান্নে ডেকেছিলেন। সেখানে দীর্ঘক্ষণ দলনেত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তবে আলোচনার বিষয়ে মুকুল মুখ খোলেননি।
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে দলের সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব মুকুলের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা। সেই সুযোগের সদ্বব্যবহার মুকুল অবশ্য দক্ষ রাজনীতিকের মতোই করেছেন। সংগঠনের একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে শীর্ষ পর্যন্ত তিনি অবিসংবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কিন্তু সারদা, বর্ধমান-কান্ড তো আছেই তার সঙ্গে একের পর এক কেলেঙ্কারিতে দলের নেতা-কর্মীদের অনেকের নাম জড়িয়েছে এবং সংগঠনের রাশ টেনে ধরতেই মমতা দলে ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
আর সেই কারণে তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে দলের সব স্তরের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মমতা। বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, কাল, সোমবার। কিন্তু হুদহুদের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় সেই বৈঠক পিছিয়ে ১৭ অক্টোবর করা হয়েছে বলে এ দিন রাতে পার্থবাবু জানান। তিনি বলেন, “আগামী শুক্রবার বিকেল চারটেতে তৃণমূল ভবনেই ওই বৈঠক হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা যেখানে রয়েছে, সেখানে জেলা থেকে জনপ্রতিনিধিদের টেনে আনা ঠিক হবে না।” দলীয় নেতৃত্ব আগে জানিয়েছিলেন, বৈঠকে দলের সব সাংসদ, মন্ত্রী জেলা সভাপতি ও গণসংগঠনের শীর্ষে থাকা নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের এক সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী ফোন করে পার্থবাবুকে নির্দেশ দিয়েছেন, দলের সমস্ত বিধায়ক, জেলা সভাধিপতি থেকে শুরু করে কাউন্সিলরদেরও ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোনর জন্য। মুখ্যমন্ত্রীর এই নয়া নির্দেশে তৃণমূল ভবনে বৈঠকের আয়োজনেও পরিবর্তন করতে হচ্ছে পার্থবাবুদের। কারণ যে বৈঠকে প্রথমে ২৫০ জনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এ বার সাড়ে পাঁচশো জনের বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
বৈঠক নিয়ে দলনেত্রীর নয়া নির্দেশ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের বক্তব্য, প্রথমত, মুকুল রায়ের ক্ষমতা পার্থ-সুব্রত জুটির মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পরে দলে নেতা-কর্মীদের মনোভাব বুঝতেই জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সামনের বছরের গোড়াতেই পুরভোটের বিষয়েও দলের অবস্থান এবং তাঁর সরকারের আমলে যে সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা মানুষের কাছে তুলে ধরার বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিতে পারেন দলনেত্রী। তবে দলের অন্য অংশের মতে, গত তিন বছরে ‘মুকুলায়নে’র সময়ে বিভিন্ন দল ও সংগঠন থেকে যথেচ্ছ ভাবে লোক ঢোকানো হয়েছে। এই তিন বছরেই দল নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে। ফলে এখন দলনেত্রী শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরতেই যে সমস্ত পদক্ষেপ করতে চলেছেন তার একটা বার্তা শুক্রবারের বৈঠকে দিতে পারেন।
দলের এক প্রবীণ নেতা অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “শেষ পর্যন্ত নেত্রী কী বলবেন সেটাই রহস্য।”