তৃণমূল আমলের পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলায় অবনতির যে সব অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছেন অধীর চৌধুরী, সেগুলি সম্পর্কে রাজ্য সরকারের কাছে ফের দ্রুত রিপোর্ট তলব করল প্রধানমন্ত্রীর দফতর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মারফত। এর আগে চার বার দিল্লির থেকে এই তাগাদা এসেছে। যদিও রাজ্যের তরফে এখনও তেমন কোনও তৎপরতা চোখে পড়েনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে অন্তত পাঁচ বার অভিযোগ করেছেন রেল প্রতিমন্ত্রী তথা প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন সভাপতি অধীর চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর দফতর (পিএমও) প্রতি বারই সে বিষয়ে রাজ্যের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠায়। কোনও জবাব না-পেয়ে দ্রুত বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে ফের দিল্লির বার্তা এসেছে। এবং এ বারও অভিযোগের জবাব এড়িয়েছে রাজ্য। এ বার নবান্নের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে, অধীরবাবুর একটি চিঠির অভিযোগের বিষয়বস্তু নিয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। কিন্তু বাকি চারটি চিঠি সম্পর্কে রাজ্য সরকার অবহিতই নয় বলে প্রশাসনের দাবি। ফলে তার জবাব দেওয়াও সম্ভব নয় বলে দিল্লিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি সূত্রের খবর: প্রধানমন্ত্রীর কাছে অধীরবাবুর সমস্ত অভিযোগের মূল প্রতিপাদ্য হল, পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ, খুন, তোলাবাজি-সহ দুষ্কৃতীদের দাপট দিন দিন বেড়ে চললেও প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। বরং তারা শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে রেল প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের পুলিশকর্তারা কী ভাবে কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের মিথ্যে মামলায় ‘ফাঁসিয়ে’ দিচ্ছেন, মনমোহনের কাছে তারও বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস প্রতি বারই অধীরবাবুর অভিযোগগুলির সত্যাসত্য জানাতে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি দেয়। গত দেড় বছরে রাজ্য একটিরও জবাব দেয়নি।
স্বরাষ্ট্র দফতরের খবর, গত বছরের ২ ডিসেম্বর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সর্বশেষ চিঠিটি পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর আবার নড়েচড়ে বসে। ওই অভিযোগপত্রে অধীরবাবু প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন, “আমি বহরমপুরের সাংসদ। আমার লোকসভা এলাকার কান্দি মহকুমার মহালন্দি হোমে মানসিক ভারসাম্যহীনদের অসহনীয় অবস্থা সম্পর্কে খবর পেয়েছিলাম। পরিস্থিতি দেখতে সেখানে গিয়েওছিলাম। কিন্তু পর দিন অনধিকার প্রবেশের জন্য আমার বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করা হয়েছে।” গত বছর ১ ডিসেম্বর কী ভাবে কংগ্রেস কর্মীদের বৈঠকে পুলিশের উপস্থিতিতে ‘শাসকদল আশ্রিত’ গুন্ডারা হামলা চালিয়েছিল, চিঠিতে তারও বিবরণ দিয়েছেন অধীরবাবু। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য: যদি মানসিক ভারসাম্যহীনদের হোম দেখতে যাওয়ার জন্য মামলা করা হয়, তা হলে বুঝতে অসুবিধে নেই যে, রাজ্য সরকারের মনোভাব কেমন। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর কথা মাথায় রেখেই বিষয়টিতে কেন্দ্রের
পদক্ষেপ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছেন অভিযোগপত্রে।
এর পরেই, গত ২৫ ডিসেম্বর পিএমও-র রাজনৈতিক শাখার অধিকর্তা রাজীব টপনো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র-সচিবকে পুরো ব্যাপারটা জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক খোঁজ নিয়ে দেখে, অধীরবাবুর আগের অভিযোগগুলি সম্পর্কে রাজ্যের কোনও রিপোর্ট আসেনি। গত ১০ জানুয়ারি মন্ত্রকের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক অধিকর্তা কে মুরলীধরণ রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয়বাবুকে চিঠি লিখে বলেন, “রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছু বিষয় উল্লেখ করে অধীরবাবু ২০১২-র ৩ অক্টোবর, ২০১৩-র ৬ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৫ মার্চ, ১১ জুন ও ২ ডিসেম্বরে মোট পাঁচটি চিঠি পিএমও’কে দিয়েছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই রাজ্যের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল, রাজ্য প্রশাসন কী কী ব্যবস্থাগ্রহণ করেছে। অথচ রাজ্য কোনও জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, বার বার বলার পরেও নয়!”
এ বার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে দ্রুত জবাব চেয়েছেন মুরলীধরণ। রাজ্যকে তিনি এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এ হেন পদক্ষেপ। যার প্রেক্ষিতে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলছেন, “অধীরবাবুর শেষ চিঠিটি নিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। রিপোর্ট এলে দিল্লিকে রাজ্যের অবস্থান জানানো হবে। দিল্লিকে তা বলেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অন্য চারটি চিঠি আমাদের কাছে নেই। ফলে জবাবও দেওয়া হয়নি।”
যাঁর চিঠি নিয়ে এত চাপান-উতোর, সেই অধীরবাবু কী বলেন?
অধীরবাবুর মন্তব্য, “যে সরকারের ন্যূনতম সভ্যতা, ভদ্রতা, বিবেচনা বোধ বা অনুভূতি নেই, তাদের নিয়ে আর কী বলব? এটা একটা অসভ্য সরকার। যারা প্রধানমন্ত্রীর তোলা প্রশ্নও অনায়াসে অবজ্ঞা করতে পারে।” পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অধীর চৌধুরী কেমন ব্যক্তি, রাজ্যের মানুষের স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তাঁর শংসাপত্র নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরকার চালাতে হবে এমন অবস্থা হয়নি। এই সরকার মানুষের সার্টিফিকেট পেয়েছে, ভবিষ্যতেও পাবে।”